পৃথিবীর মানুষের সকল কাজকর্ম দুভাগে বিভক্তÑ হালাল-হারাম; সৎ-অসৎ; শুদ্ধ-অশুদ্ধ; বিশুদ্ধ-নিষিদ্ধ; কল্যাণকর-অকল্যাণকর; ভালো-মন্দ ইত্যাদি। অপরদিকে মানুষও দুভাগে বিভক্তÑ মুসলিম-কাফির; বিশ^াসী-অবিশ^াসী; স্বীকারকারী-অস্বীকারকারী; ধার্মিক-অধার্মিক; নেককার-বদকার; নেকি-গোনাহ; জান্নাতি-জাহান্নামি; ঈমানদার-নাস্তিক; মুমিন-মুশরিক; সিদ্দিক-মোনাফেক; সত্যবাদী-মিথ্যাবাদী; মুত্তাকি-শয়তান; আল্লাহওয়ালা-তাগুত ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের শত শত জায়গায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বারবার বলেছেন, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্যই পৃথিবী ও পরকালে সুখ, শান্তি ও সফলতা। (দলিলÑ ২ : ২৫; ১০৩ : ৩; ২ : ৮২; ৭ : ৯, ৪২; ৪ : ৫৭, ১৭৩; ১০ : ৯, ১৮ : ১০৭; ৯৫ : ৬; ৯৮ : ৭; ৮৪ : ২৫, ৮৫ : ১১ ইত্যাদি) পাশাপাশি পরকালে জান্নাতের চিরস্থায়ী নেয়ামত এবং সেখানে বসবাসের গ্যারান্টি। মজার ব্যাপার হলো, সৎকাজের পূর্বশর্ত রাখা হয়েছে ঈমান। অর্থাৎ ঈমানবিহীন সৎকাজে বা নেক আমলে পার্থিব ও পরকালীন, মুক্তি ও সফলতা নেই। আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)-কে রাসূল হওয়ার ব্যাপারে নিজেই সাক্ষ্য দান করেছেন। আল্লাহ বলেন, মুনাফিকরা তোমার কাছে এসে বলেÑ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, তুমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূহকে ঢালরূপে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ। (৬৩ : ১-২)। রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে সমস্ত মানবজাতির জন্য সুসংবাদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহ আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন, আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (৩৪ : ২৮)। অথচ আমরা রাসুলের (সা.) চরিত্র নিয়ে বা তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা না করে; অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে মাঠ গরম রাখছি। তাঁর পোশাক, পাগড়ি, জোব্বা, দাঁড়ির দৈর্ঘ্য, পাজামা বা পরনের কাপড়ের পরিধি, টাখনুর কতটুকু উপরে পাজামা পরতে হবে; এসবই আজ আমাদের ধর্ম তথা এসব জানা ও মানা জরুরি মনে করছি। সত্যিই আফসোস! যে লোক রাসূলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি তোমাকে (হে মুহাম্মাদ), তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি। (৪ : ৮০) তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রাসূলের অনুগত হও এবং আত্মরক্ষা করো। কিন্তু যদি তোমরা বিমুখ হও, তবে জেনে রাখো, আমার রাসূলের দায়িত্ব প্রকাশ্য প্রচার বৈ নয়। (৫ : ৯২) হে ঈমানদাররা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য করো এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না। (৮ : ২০) হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না। (৪৭ : ৩৩)। রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে আল্লাহ বিশ^বাসীদের জন্য রহমতরূপেই প্রেরণ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, আমি তোমাকে বিশ্ববাসীদের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। (২১ : ১০৭)। রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) সমগ্র বিশ^বাসীর জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী। (৩৪ : ২৮)। অতএব মুহাম্মাদ (সা.) রাসূল এবং তিনি এসেছেন সমগ্র বিশ^বাসী ও বিশ^জাহানের জন্য। এ জন্যই আল্লাহ বিশ^নবীকে সম্বোধন করে সকল হুকুম-আদেশ-নিষেধ-উপদেশ-আইন-ফায়সালা-করণীয়-বর্জনীয় ইত্যাদির বর্ণনা, ঘোষণা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে পাঁচ শতাধিক নির্দেশনা রয়েছে আল কুরআনে। ওইসব নির্দেশনা-আদেশ-নিষেধ ও উপদেশই হলো আমাদের তথা বিশ^বাসীর জন্য সুখ, শান্তি ও সফলতার সোপান। এভাবেই কুরআন হলো মানব জীবনের মুক্তির পূর্ণাঙ্গ, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, স্পষ্ট, বিশদ, সহজ, সরল, বোধগম্য সংবিধান বা পড়হংঃরঃঁঃরড়হ. রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-ও কাউকে হাদিস লিখতে ও সংরক্ষণ করতে বলেননি। কুরআন আর কুরআনের তাফসির এক নয়। তাফসিরকারক বা ফকিহগণ তাদের মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তারা কেউ (হাদিস সংকলকরা, তাফসিরকারকরা, ফকিহগণ, সিরাত লেখকগণ) তাদের গ্রন্থকে সহীহ এবং বাস্তবায়নযোগ্য ও চ‚ড়ান্ত ফায়সালার মানদÐ বলেননি। তারা গবেষণা এবং সংকলন করেছেন অধিক বিশ্লেষণ, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য। তবে কারা হাদিস, ফিকাহশাস্ত্র, সিরাত, তাফসির গ্রন্থ, ইসলামি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে মুসলিমদের সকল সমাধান বের করতে বললেন? ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা শিক্ষায় করা সিলেবাস ও বই-পুস্তক নির্বাচন করলেন কারা? অবশ্যই ওইসব খ্রিষ্টান, ইহুদি ও ব্রিটিশ? ইসলামে কেন এত দল, মত, ফেরকা, গ্রæপ, মারামারি, হানাহানি, ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হলো? আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে! এতো মাসলা-মাসায়েল, ফাজায়েল, মতপার্থক্য কারা বের করল? এসবের ভিত্তি কেন কুরআন হলো না? কুরআন মাজিদের পাশে বুখারি শরিফ, মাজাহ শরিফ, এতো শরিফ কোথা থেকে কারা নিয়ে এলো? কুরআনের পাশে কি অন্যান্য মানবরচিত বা সংকলিত বা সংগৃহীত গ্রন্থ শোভা পায়? কুরআন কি একমাত্র, চ‚ড়ান্ত, শুধুমাত্র, গ্রহণযোগ্য অনুসরণীয় গ্রন্থ নয়? অবশ্যই এতে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। কুরআনে কোনো সন্দেহ নেই। শতভাগ সত্য, সম্পূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ, পরিপূর্ণ, বিশদ, সহজ, সরল ও বিশুদ্ধ ঐশী গ্রন্থ? আমাদের হেদায়েতের জন্য কুরআনকেই অনুসরণ করা উচিত। এটিই আল্লাহর নির্দেশ। এর মধ্যেই সব রয়েছে। পূর্বে যারা গত হয়ে গেছে এবং তারা যা করেছে; তা তাদেরই জন্য। তারা কী করত, সে জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না (২:১৩৪)। এটি কুরআনের নির্দেশনা। এরপরও কি আমরা ইতিহাস ও মানব রচিত বা সংকলিত গ্রন্থের উপর নির্ভর করব?