"মধুরাত"বইটির প্রথমের কিছু অংশ: বাবু দিশেহারার মতাে বাড়ি ঢুকল। আপা ফিরেছে পাঁচটা থেকে তাে কারফিউ। বারান্দার ইজি চেয়ারে পা তুলে গুটিসুটি হয়ে আছেন মতিন সাহেব। গায়ে হগেরুয়া রঙের চাদর। হাতে অনেক দিনের পুরনাে একটি পত্রিকা। খুবই মনােযােগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন তিনি। মতিন সাহেবের চোখে মােটা কাচের চশমা। নিরীহ গােবেচারা মুখটা পত্রিকা পড়ার সময় আরও নিরীহ ধরনের হয়ে যায়। এখনও তাই হয়ে আছে। মতিন সাহেবের ছেলে বাবু বাড়ি ঢুকে যে চিষ্কার করে কথাটা বলল মতিন সাহেব যেন তা শুনতেই পেলেন না। ভদ্রলােকের স্বভাবটা এরকমই। যখন যেদিকে মনােযােগ দেন খুব সহজে সেদিক থেকে মনােযােগ ফেরান না। কারফিউর কথা বলে বাবার মনোেযােগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছিল বাবু। যখন দেখল বাবা ফিরেও তাকাননি বাবুর দিকে, বাবু চিল্কার করে মাকে ডাকল। মা ওমা শুনেছ পাঁচটা থেকে তাে কারফিউ! আপা ফেরেনি? কোনও ব্যাপারে মনােযােগ হঠাৎ ভেঙে গেলে মতিন সাহেব বেশি বিরক্ত হন। এখনও হলেন। পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে বাবুর দিকে তাকালেন। কী হয়েছে। অত চিল্কার করছিস কেন? অন্য সময় হলে বাবু একটু থতমত খেত। এখন খেল না। বেশ ঝাঁঝাল গলায় বলল, বারবার বলছি পাঁচটা থেকে কারফিউ, আপা ফিরেছে কি-না,না তুমি শুনছ না মা ততক্ষণে মতিন সাহেবের স্ত্রী বেরিয়ে এসেছেন বারান্দায়। একবার স্বামীর মুখের দিকে তাকাচ্ছেন তিনি একবার ছেলের মুখের দিকে। কী হয়েছে, এ্যা!
১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের জন্ম। লেখনীশক্তির পাশাপাশি তার রয়েছে নাট্যরচনায় পারদর্শিতা। বর্তমানে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদপত্র ‘কালের কন্ঠ’-এর সম্পাদক পদেও নিয়োজিত রয়েছেন তিনি। শিশুতোষ গল্প দিয়ে সাহিত্য অঙ্গনে এ গুণী লেখকের প্রবেশ, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ‘কিশোর বাংলা’ নামক এক পত্রিকায়। তবে পাঠকের নজরে পড়েছিলেন ‘সজনী’ নামের ছোট গল্প লিখে। খুব অল্প বয়সে তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফলে তার লেখার বিষয়বস্তুতে কোনো জটিল সমীকরণের দেখা মিলতো না, পাঠককে বিমল আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমদিকে তিনি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে পরিহার করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমূহ-তে মুক্তিযুদ্ধ, হাজাম সম্প্রদায়ের জীবন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুঃখগাথা, পাটচাষী, গ্রাম বাংলার সমাজের এক নিখুঁত চিত্রও ফুটে উঠতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, তিনি নিজেই লেখার এরকম বিপরীতধর্মী দুটি ধরন আপন করে নিয়েছেন, আর এক্ষেত্রে তার অণুপ্রেরণা ছিলেন সমরেশ বসু। ইমদাদুল হক মিলন এর বই সমগ্র-তে স্থান পেয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক নাটক এবং প্রায় দু’শো উপন্যাস। শিশুতোষ গল্প এবং ভৌতিক উপন্যাস রচনাতেও তার জুড়ি নেই। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিশীলতার কারণে বাংলা উপন্যাস ইমদাদুল হক মিলন এর কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ না, পশ্চিমবঙ্গেও তার সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে। দুই বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার বহুল পঠিত উপন্যাস হলো ‘নূরজাহান’। এছাড়াও ইমদাদুল হক মিলন এর উপন্যাস সমগ্র বিভিন্ন পাঠকপ্রিয় উপন্যাসে ঠাসা। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘জিন্দাবাহার’, ‘নিঝুম নিশিরাতে’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’, ‘কে’, ‘তাহারা’, ‘ভূতের নাম রমাকান্ত কামার’ ইত্যাদি। দেশি-বিদেশি নানা সম্মানজনক পুরস্কারের পাশাপাশি ২০১৯ সালে তিনি একুশে পদক পান।