ফ্ল্যাপে লিখা কথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত ও কবি আচর্য দীনেশচন্দ্র সেন রচিত ‘রামায়ণী কথা’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-“কবি-কথা-কে ভক্তের ভাষায় আবৃত্তি করিয়া তিনি (দীনেশচন্দ্র সেন) আপন ভক্তির চরিতার্থতা সাধন করিয়াছেন। এইরূপ পূজার আবেগমিশ্রিত ব্যখ্যাই আমার মতে প্রকৃত সমালোচনা।” গ্রন্থটির গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির মধ্যেই যথার্থ পরিস্ফুটিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সাধক-পুরুষ দীনেশচন্দ্র সেন বাল্মিকীর মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর বিভিন্ন চরিত্র দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী, ভরত , হনুমান ও বালী- কে নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ পর্যালোচনা করেছেন গভীর বিশ্লেষণে। এইসব চরিত্রকে তিনি কল্পলোকের অবস্থান থেকে টেনে নামিয়ে এনেছেন ভারতবর্ষীয় সাজের জীবন্ত মানুষের পর্যায়ে। তার ফলে এই অঞ্চলের মানুষতো বটেই, বিশ্ব-মানবসমাজও ‘রামায়ণী কথা’ বা তার অনুবাদ পড়ে চরিত্রগুলোকে নিজ নিজ সমাজ-সংস্কৃতির চলমান চরিত্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে এর সাহিত্যরস আস্বাদন করতে সক্ষম হবেন আনন্দচিত্তে। বইটির শেষদিকে ‘রামায়ণ ও সমাজ’ শিরোনামের অধ্যায়ে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন- ‘রামায়ণ কাব্য অপূর্ব সামাজিক কাব্য। উথা যৌথ পরিবারের প্রীত-সমুদ্রের উচ্ছলিত লীলা দেখাইতেছে, কিন্তু মানবগৃহের ঊর্ধ্বে আশ্বাস ও শান্তির যে জয়দুন্দুভিধ্বনি শ্রুত হইয়া থাকে, তাহারই অভয় ও নিত্য উদ্দীপনাময় রব উহার চরিত্রবর্গকে কার্যে প্রবুদ্ধ করিতেছে’।
রামায়ণী কথা দীনেশচন্দ্র সেনের এক অসামান্য পর্যালোচনাগ্রন্থ যা বাল্মিকীর মহাকাব্য রামায়ণকে অধ্যয়ন ও উপলব্ধি করতে পণ্ডিত-অপণ্ডিত সবাইকে সাহায্য করবে নিঃসন্দহে।
(১৮৬৬-১৯৩৯) ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা জেলার বগজুরী গ্রামে জন্ম নেন দীনেশচন্দ্র সেন। ব্রাহ্ম-বিশ্বাস অনুসারী শিক্ষক-উকিল ঈশ্বরচন্দ্র সেন ও সনাতন ধর্মাবলম্বী রূপলতা দেবীর সন্তান ছিলেন তিনি। বাল্যকাল থেকে বাংলা ভাষা ওসাহিত্যের গবেষণায় তিনি সাধক হয়ে ওঠেন। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল ও ঢাকা কলেজে অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি এন্ট্রান্স ও এফ. এ. (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট ছাত্ররূপে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন। তিনি হবিগজ্ঞ হাইস্কুল, কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন ও ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার নিযুক্ত হন এবং পরের বছরই তিনি সিনেট সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ১৯১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলাে নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে অভিষিক্ত হন। পরের বছর তাঁকে ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) উপাধি দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় । সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই পণ্ডিত অসম্ভব নিষ্ঠাবান শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁর মতাে মানবপ্রেমী সমাজে দুর্লভ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরেক দিকপাল কবি জসীম উদ্দীনকে দীনেশচন্দ্র সেনের পিতৃতুল্য অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। পূর্ব বাংলার প্রাচীন গীতিকবিতা (পুঁথি) সংগ্রহে বিশেষভাবে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহে কবি জসীম। উদদীন কাজে লাগিয়েছিলেন। বাংলার প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় দীনেশচন্দ্র সেন বিশাল ভূমিকা রেখে গেছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে কাব্যগ্রন্থ, ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে তাঁর সত্তরখানা অত্যন্ত মূল্যবান বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করান এবং নিজে ইংরেজীতে ‘History of Bengali Language and Literature' পুস্তক রচনা করেন; এই বইটি রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়ার পথ সুগম করে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে দীনেশচন্দ্র সেন ইহলােক ত্যাগ করেন।