দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কাল ছিল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি, জাপান ও ইতালির সমন্বয়ে গঠিত অক্ষ শক্তি। বর্তমান বাংলাদেশ তখন ভারতবর্ষের অংশ ছিল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশ হওয়ায় মিত্রবাহিনীর পক্ষেই ছিল। ১৯৪৩ সালে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জাপান প্রায় সমগ্র বার্মা দখল করে ভারতের পূর্ব সীমান্তে অবস্থান নিলে ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। জাপানকে প্রতিরোধ করার জন্য বার্মা ও চীনে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও রসদ মিত্রবাহিনী ভারতবর্ষ থেকে প্রেরণ করত। বার্মায় সামরিক অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৪তম আর্মির তৎকালীন কমান্ডার ছিলেন ফিল্ড মার্শাল স্লিম। স্লিমের কমান্ড পোস্ট বর্তমান কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ছিল। এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনী জাপানকে কাবু করতে ভারতের পূর্ব অংশ এবং বর্তমান বাংলাদেশে ১৯৪০ এর দশকে বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর ও এয়ারফিল্ড নির্মাণ করে। তন্মধ্যে তেজগাঁও এ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রানওয়ে নির্মিত হলে বাংলাদেশে আধুনিক বিমানের যাত্রা শুরু হয়। এ বিমানবন্দরসমূহ থেকে বার্মায় মোতায়েনকৃত মিত্রবাহিনীর সেনাদের আক্রমণ সহায়তা, গোলা পরিবহণ, রসদ সরবরাহ, অসুস্থদের হাসপাতালে স্থানান্তর ও ফটোগ্রাফিক জরিপ করা হতো। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাংশের বিমানবন্দরসমূহে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর আধিক্য এবং দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের বিমানবন্দরসমূহে ব্রিটিশ বিমানের সংখ্যাধিক্য পরিলক্ষিত হয়। চীন ও উত্তর বার্মায় যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বিমানে পণ্য সরবরাহে হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ দিয়ে বিস্তৃত হাম্প রুটটি ছিল খুবই দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চল বার্মার সীমান্তবর্তী হওয়ায় এয়ারফিল্ডের সংখ্যাধিক্য লক্ষণীয়। এখানে বিমানসমূহ কখনো সমুদ্রতটে বা মার্স্টন মেট নির্মিত উদ্ভাবিত ল্যান্ডিং স্ট্রিপে অবতরণ করত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বিমানবন্দরসমূহ স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিল। এই বিমানবন্দরসমূহের বার্মা ক্যাম্পেইনে মিত্রবাহিনীর বিজয়ে ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে চলে যাবার পর একদা ব্যস্ত এসব বিমানবন্দর, এয়ারফিল্ড ও এয়ারস্ট্রিপের অধিকাংশই কালের পরিক্রমায় হয়ে পড়ে পরিত্যক্ত। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই সকল বিমানবন্দর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক রেখেছিল। শমসেরনগর বিমানবন্দর ছিল কিলো ফ্লাইটের, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে পরিণত হয় তার প্রথম ফরোয়ার্ড বেস। ভারতীয় বিমানবাহিনী অনেক বিমানবন্দরের রানওয়েতে বোমা বর্ষণ করে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ব্যবহার অনুপযোগী করে দেয়। স্বাধীনতার পরে প্রায় সকল বিমানবন্দর সংস্কার করে সচলের প্রচেষ্টা করা হয়। তবে অনেক উদ্ভাবিত অস্থায়ী এয়ারফিল্ডের অস্তিত্ব আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একদা ব্যপ্ত ও ঐতিহাসিক বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী এই এয়ারফিল্ডসমূহ আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। উপাত্ত সংগ্রহে স্থানীয় অনেক বয়োবৃদ্ধের এই বিষয়ে অজ্ঞতাও লক্ষ্য করা যায়। ভৌগোলিক অঞ্চল ভিত্তিক বিমানবন্দরগুলোর পর্যায়ক্রমিক আলোচনা এই বইতে করা হয়েছে। বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে বর্তমানে সচল বিমানবন্দরসমূহের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব বিমানবন্দরেরও অধিকাংশ প্রাথমিক স্থাপনা বর্তমানে পরিত্যক্ত। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা অঞ্চলে ১৯৪১-১৯৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত চট্টগ্রাম এয়ারফিল্ডের পূর্ব অংশে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ম এয়ারফোর্সের রসদ ডিপো এবং বৃটিশ একাধিক স্কোয়াড্রনের ঘাঁটি ছিল। প্রাথমিক অনেক পরিত্যক্ত স্থাপনা পরবর্তীতে সংস্কারান্তে এটি সচল হয় এবং বিএএফ বেস চট্টগ্রাম হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৮২ সাল থেকে এটির নামকরণ হয় বিএএফ বেস জহুরুল হক। তুলনামূলক নতুন, স্বল্প পরিসর সীমিত ব্যবহার ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য কম থাকায় বগুড়া, চট্টগ্রামের স›দ্বীপ, গাজীপুরের রাজেদ্রপুর, টাঙ্গাইলের রসুলপুর, টাঙ্গাইলের পাহাড়কাঞ্চনপুর, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও পটুয়াখালী স্টলপোর্ট সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি। বইটির বানান রীতি বাংলা অভিধান অনুসৃত। প্রায় সকল পরিত্যক্ত বিমানবন্দরেরই অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ উল্লেখ করা হয়েছে, যার অধিকাংশ www.armedconflicts.com ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। পরিত্যক্ত ও বিস্মৃত এই বিমানবন্দরসমূহের অনেক দুর্লভ উপাত্ত সংগ্রহে সহায়তাকারী বিবিধ ব্যক্তি ও ওয়েবসাইটের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বইটিতে কোন ঐতিহাসিক বা ব্যাকরণগত ত্রæটি পরিলক্ষিত হলে তা অনিচ্ছাকৃত ও তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। বইয়ের অধিকাংশ ছবি বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। বিবিধ তথ্যের উৎসসমূহ বইয়ের শেষাংশে সন্নিবেশিত।
Title
বাংলাদেশের পরিত্যক্ত বিমানবন্দরসমুহের বিস্মৃত ইতিহাস