'জননী' এক সদ্য বিবাহিতা বালিকার মা হয়ে ওঠার মহাকাব্যিক উপাখ্যান। পরিণত সংসারের মূল কান্ডারী হওয়া এক মায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। মানিকের সুনিপুণ লেখনীর জোরে স্রোতস্বিনী নদীর ন্যায় কাহিনী এগিয়ে চলে, গড়িয়ে যায় বছরের পর বছর। ঋতুচক্রের গতিময় চালচলনের সাথে পাল্লা দিয়ে, শ্যামার জীবনে আসে সুখের পরশ, আসে ততোধিক কষ্ট, দরিদ্র ও পীড়ার বিষ দংশন। দিগন্তবিস্তৃত এই রচনার ভাষা সুন্দর ও ভীষণ মায়ামাখা। পূর্বের 'দিবারাত্রির কাব্যের' মতন তাত্ত্বিক বা দার্শনিক না হলেও, মানিকের গদ্যের সচ্ছতা এখানেও উপভোগ্য। বারংবার ভাবতে উদ্যত করে, কিভাবে কেবল পঁচিশ বছর বয়সে লিখলেন এই উপন্যাস। কিভাবে যৌবন ও তারুণ্যে আবেষ্টিত মায়াকাননে বসে, রচলেন এক নারির জীবনের এমন সুচারু প্রতিকৃতি। শ্যামার মমতা, ভালোবাসা, বিদ্বেষকে ক্যানভাসে ধরে, মাতৃত্বের বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি আঁকলেন মানিক। শ্যামা সেখানে কখনো বাঘিনী ন্যায় হিংস্র, কখনও নিরর্থক খল-পবৃত্তির আবার কখনো বা ভীষন করুণার পাত্রী। জননী শব্দটির প্রকৃত ভার, আর অজস্র জটিল সংজ্ঞা কলমের কালির প্রতিটি আঁচড়ে অমর করে গিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্যামার মত নিস্বার্থ জননীদের আমরা কি সকলেই চিনি না? আমাদের চারিপাশে চার দেওয়ালের পরিধির মাঝে, এদের কে প্রায়শই যে দেখা যায়। শ্যামারা তাই সকলেই নিজগুণে এক একটি পূর্ণ উপন্যাস। এদের সবাইকে নিরবে নিভৃতে পড়ে দেখবার সময় বা বিলাসিতা কোনোটাই আমাদের থাকে না। 'জননী'র হাত ধরে সেই আশা কিছুটা হলেও পূর্ণতা পেয়েছে।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।