“আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে ” বইটি সর্ম্পকে কিছু কথাঃ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে, দেশ ও জাতি তার রায় দিয়েছে। একটি কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা করা একান্ত প্রয়োজন। মানুষের কল্যাণ যদি রাষ্ট্রের লক্ষ্য হয় তাহলে এই জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় কথা শোনে এবং কথা বোঝে সে ভাষায় রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হওয়া আবশ্যক বই কি! তাই এই গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান-এর আত্মমগ্ন জিজ্ঞাসা: আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা কেবল বাংলা ভাষায় কথা বলে? লেখকের ভাষায় “দেশ যেভাবেই শাসিত হোক, তার কাঠামোতে যে পরিবর্তন আসুক না কেন, দুর্ভাবনায় কালক্ষেপ না করে, সেই বাংলা ভাষাকে সুদৃঢ় করা আজ আমাদের অন্যতম কাজ।“ কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, ‘বাদী যখন ডিক্রি পায়, তখন তার নাভিশ্বাস ওঠে।’ যে ভাষা স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে একক মর্যাদা লাভ করেছে তার সর্বস্তরে বাস্তবায়ন যেন অবহেলিত! আইন বাংলাতে না লিখে শুধু আদালতে বাংলা চালু করে অথবা আদর্শ পাঠ্যপুস্তক বাংলায় প্রকাশ না করে, উচ্চ শিক্ষা বাংলার মাধ্যমে প্রবর্তন করে আশু সুফল লাভ সম্ভব নয়। লেখক মনে করেন যে, আজও যাঁরা বাংলা ভাষায় নিজেদেরকে প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করছেন, ‘ঘরে তাঁরা একদিন ফিরে আসবেন’। পৃথিবীব্যাপী পরাশক্তি অথবা প্রতিটি রাষ্ট্র যেখানে তার নিজের কথা শোনাতে, তার নিজের ভাষা শেখাতে ব্যাকুল সেখানে আমরা কেন পিছিয়ে থাকবো! বিদেশী ভাষা শেখার আপত্তি থাকতে পারে না, কিন্তু ‘নিজের ভাষায় যার গোড়াপত্তন হবে না, সেই সঞ্চারী মন বৃথাই ভিন্ন ভাষার অভিধানে ব্যাকরণে ঘুরে মরবে’। লেখক মনে করেন মৌলিক প্রশ্নে সিদ্ধান্তে আসার পর আর তর্ক নয়। দেশের বেশির ভাগ মানুষ যখন কোনো ভাষাই শেখেনি, শুধু বাংলায় কথা বলে তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরিবর্তে মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে পৌনঃপৌনিক আলোচনা জাতির স্থিতির জন্য মঙ্গলকর নয়। আমাদের বিশ্বাস, ৫২’র ভাষা-আন্দোলনের সৈনিক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা ভাষাকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠার যে উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন বাঙালির জাতীয় জীবনে তার অনিবার্য প্রতিফলন ঘটবে।
Title
আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী মুহাম্মদ জহির উদ্দীন ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং আইনজীবী। শৈশব থেকেই রাজনৈতিক বিষয়াদি ও সংস্কৃতির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। সহকারী এডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৭৬ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলাকালীন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একাধারে একজন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এবং অভিধানপ্রণেতা। তিনি একজন ভাষা সৈনিক; ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই সমূহ হলো ‘রবীন্দ্র সম্বন্ধে সঞ্জনা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮)’, ‘যথা-শব্দ (১৯৭৪)’, ‘কোরআন সূত্র (১৯৮৪)’, ‘ভাষার আপন পর (২০১২)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি। সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (২০০৭) সহ আরো বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমগ্র পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।