সৈয়দ মহিউদ্দিনের সঙ্গে (মহি আল ভাণ্ডারী) জুলাই ১৫, ২০১৮ তারিখে কিছু দরকারি আলাপ সারবো বলে আর তাঁর পছন্দের কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের কাতালগঞ্জের একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করি বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে। তিনি কিছু তথ্য দিলেন তাঁর সংগীত জীবনের, কিছু পেপারকাটিং দেখালেন। কিছু প্রয়োজনীয় নোটও নিলাম। সবশেষে হাতে দিলেন তাঁর দুটি আলোকচিত্র। তিনি চান ও দুটো থেকে যেকোনো একটি প্রচ্ছদজুড়ে ব্যবহার করা হোক তাঁকে নিয়ে পুষ্পকরথ-এর বিশেষ আয়োজনে। তাঁর ইচ্ছের প্রতি সম্মতি জানিয়ে ওই আলোকচিত্র দুটি সাধারণ একটি কাগজের প্যাকেটে ঢুকিয়ে আমাদের বসার টেবিলটার একধারে রাখি। ওই সময় হোটেলবয় মেঝেতে ঝাড় দেবে বলায় আমরা ওখান থেকে সরে পাশের আরেকটি টেবিলে। যাই। তখনও আরো কিছু কথা ও কাজ বাকি ছিল তাঁর সঙ্গে। ওসব কাজ সেরে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে এসে দেখি, অন্যসব কাগজপত্তর থাকলেও তাঁর সেই ফোটোগ্রাফ দুটির প্যাকেটটি নেই! তাৎক্ষণিক ফোন দিয়ে জানা গেল, তাঁর সঙ্গে থাকা কাগজগুলোর ভেতরেও ওটা নেই। দ্রুত রিকশাযোগে ওই রেস্তোরাঁয় গিয়ে বয়- ওয়েটারদের জিগ্যেস করেও হদিস পাওয়া গেল না। যদিও তাকে আসতে হবে না। বলেছিলাম, দেখি সৈয়দ মহিউদ্দিনও হস্তেদন্তে উপস্থিত। এ রকম বিহ্বল অবস্থায় এক বয়স্ক ওয়েটার ছবির ওই প্যাকেটটা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। বলেন, ঝাড় দেবার পর বালকটি দৈনিক কাগজের ওই সাধারণ প্যাকেটটি বাজেকাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেয়। মহিউদ্দিন ভাইয়ের চেহারার সঙ্গে ছবি দুটির মিল দেখে আর আমাদের তল্লাশিতে আঁচ করেন, বোধ হয় এই ছবিগুলোই খোঁজা হচ্ছে। আমার মনে স্বস্তি ফিরে এলেও, দেখলাম, ভাণ্ডারী ভাই ছবি দুটি হাতে নিয়েই টুকরো-টুকরো করে ঝটপট ফেলে দিলেন মেঝেতে || শান্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'ময়লার ঝুড়ি থেকে নেয়া এ ছবি যাবে না, বাবা ভাণ্ডারী নাখোশ হবেন। আমি নতুন ছবি দেবো।' আমার ভাবনা : দুর্ঘটনার শিকার, এখনো ভালোভাবে চলাফেরা করতে না-পারা। সত্তরোর্ধ্ব মানুষটার কষ্ট না হোক। ওই ছবি আবারও পরিষ্কার হয়তো করা যাবে, তাতে দৌড়ঝাঁপ যেটুক হবে, তাও তাঁর এ রকম অবস্থায় কম ধকলের নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর মনের অবস্থা বুঝে আমি নিশ্চুপ রইলাম। দক্ষিণ এশিয়ায় সুফিদর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতি আজীবন গভীরভাবে আস্থাশীল সৈয়দ মহিউদ্দিন। এ প্রসঙ্গে সিরীয় কবি আদোনিস বা আলী আহমাদ সায়ীদ এসরারের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন : 'যুক্তির বলয়ের বাইরের জগতটাকে বোঝার জন্য পশ্চিমা শিল্প ও সাহিত্য পরাবাস্তববাদ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু একই উদ্দেশ্যে পশ্চিমা জগতের বাইরে তারও বহু আগে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটে। যার দিকে আমরা তাকাইনি। আরবের দেশগুলোতে, বিশেষ করে লেবাননে পরাবাস্তববাদের গভীর প্রভাব পড়েছে। পরাবাস্তববাদের যে গভীর ধারাটি আরবের জমিতে জন্য নিয়েছিল, আরবদের উচিত সেই সুফি কবিদের খোঁজখবর নেয়া। সৈয়দ মহিউদ্দিন রচিত গীতভাণ্ডার এই সুফিদর্শনকে একালের মানুষের মনে কারাম সুরের রসে পরিবেশনের মাধ্যমে ব্যাপক লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সেখানে তিনি অনবদ্য ও স্বতন্ত্র। চট্টগ্রামে এই সুফি ঘরানার উদ্ভবের পেছনের ইতিহাসও চমকপ্রদ, ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের সময় ওটা। ভারতবর্ষে প্রায় দুশো বছরের কায়েমি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তখন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পাশাপাশি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও চলছে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ও প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় ভারতের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ফারাক সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রলম্বিত করার উদ্দেশ্যে উপনিবেশিকেরা যেসব ছল- চাতুরির আশ্রয় নেয় তার মধ্যে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিককাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে বিভেদ সৃষ্টি করা। ব্রিটিশ কূটনীতির কাছে ওটার বহিঃপ্রকাশ ছিল 'ভাগ করো, শাসন করো' নীতিতে। শাসকগোষ্ঠীর এই ভেদনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সচেতনতার পাশাপাশি মুসলিম আলেম সমাজ ও হিন্দু ধর্মবেত্তাদের মধ্যে ঐক্যের যে ফল্গুস্রোত সে সময়ে বহমান ছিল, তারই একটি তৃণমূলীয় উদ্ভাসন হলো মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ও তাঁর সমকালের চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সুয়াবিল গ্রামে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুরুদাস ফকির বা গুরুদাস পরমহংসের মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠা। তাঁরা দুজনই ছিলেন নিজ-নিজ সাধনমার্গে সিদ্ধপুরুষ। তাঁরা প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতিকূল তৎপরতার ভেতর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে-অস্মিতা লালন করেন পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণুতার, আর তার সুদূরপ্রসারী আবেদন তাঁদের কাল ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে দুর্বার গতিতে নিয়ে যেতে যে-প্রণোদনা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা, বহু ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে আজও তা সচল ও সপ্রাণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওই সুবেদী পরম্পরা উভয় দিকের উৎপীড়িত আত্মার জন্যে যে-প্রশান্ত বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল সারা ভারতের লাখো লাখো সাধক ও মাটির সন্তানকে তা চুম্বকের স্বভাবে আকর্ষণ করেছে। সেই ধারার অনলপ্রবাহে পুড়ে ছাই হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার প্রেতাত্মারা, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের কলুষতা, জাতপাতবর্ণের ঘৃণ্য আচার-আচরণকারীরা। সৈয়দ মহিউদ্দিন সেই সাধনপথের অনুরাগী এক নতুন জীবনমন্থনের সুদক্ষ অরণি। বিগত শতকের আশি'র দশক থেকে এই অরণির স্পর্শ যে নতুন অগ্নিশিখার আলো ছড়ালো সারা বাংলাদেশে সেটি তাঁর রচিত ও সুরারোপিত মাইজভাণ্ডারী গানের অপূর্ব সম্ভার। একটি ছোট্ট উদাহরণ : তুমি প্রেমের নায়ক সুরের গায়ক বিশ্ব গীতিকার তুমি সর্বকরা সর্ববলা নিপুণ ভাষ্যকার তুমি নূর-এ-রূপম দয়ার কসম কাঙ্গালেরই কুল তুমি শাস্ত্র কিতাব অংক হিসাব যুক্তি চূড়ান্ত তুমি মৰ্ত্তামণি পাতালখনি গভীর অনন্ত তুমি সেনাপতি দ্রুতগতি শত্রু শূল। তুমি ঐশী আলো কলব জ্বালো সরাও অন্ধকার তুমি সত্যপথের কুদরতের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় তুমি খেলছ বলে দলে-দলে মাঠে হুলুস্থুল ॥ তুমি ৭-এর নিদান ভাগ্যবিধান ললাটেরই তাক তুমি ফাগুন হাওয়া কোকিল পাওয়া যৌবনেরই ডাক তুমি জিকির চেমা স্বর্গী মেমা আসমানি বাউল তুমি সদ্যশিশু কৃষ্ণযিশু কালের সম্মোহন তুমি পঞ্চবরঙ্গী মানবসঙ্গী মুক্ত আলিঙ্গন তুমি ভেলহারামি মনগোঁড়ামি করিছ নির্মূল। পূর্বসূরি বহু নামজাদা কবি ও সাধক, গীতিকার ও সুরকারের অবদানে ঋদ্ধ মাইজভাণ্ডারী গানের ঘরানায় নতুনতর প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেছেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। আবার ঠিক এই তরিকার পাশ ঘেঁষে সৈয়দ মহিউদ্দিনের কলমে কলসে উঠলো চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবনের আরেক ভাষ্য। এ কোনো আপতিক বা আকস্মিক কিছু নয়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার ভেতরেই রয়েছে গণমানুষের প্রতি, তাদের বৈচিত্র্যমণ্ডিত জীবনযাপনের প্রতি সহজিয়া, দরদিয়া পক্ষপাত। সৈয়দ মহিউদ্দিনকে সেই নরনই চালিত করেছে জনপ্রাণস্রোতে। চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবনের অবিমিশ্র ভাষাবাহনে তিনি রচনা করলেন হৃৎছোয়া সুরের আয়ত ভুবন। এখানে তাঁর কবিত্বমণ্ডিত উপমাবহুল শব্দচয়নের ঝংকারে খুলে গেল প্রাকৃত ও চলমান চট্টগ্রামি জীবনধারার খাসমহলের সকল দুয়ার। এখানকার আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন, জীবনরসিক, অরণ্য পাহাড় আর সাগরের উদাসী হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মৃত্তিকার সন্তানেরা তাঁর গানের কথা আর সুরের জাদুকরি ছোঁয়ায় খুঁজে পেল জীবনের আসল দ্বৈরথ ও ছন্দের মর্তবা, যেমন : গর্কি ভুয়ান, বন্যা খড়া মোহামারী ঘুর্নিঝড় ভাসাই মারে ধ্বংস গড়ে মাইনচে-ত আর বাই নরর হল কামর ধান্ধা চলের আবার নয়া সিষ্টি অর ভাংগা গাছত নয়া ঠেইল পাতা মেলি দেখার খেইল পংখি আবার উডের-ঘুরের চুপে প্রেমর কথা কার দুনিয়া দুরগইত্যা বোঝা বাচন কঠিন মরণ সোজা পঞ্চীতির ইচ্ছার উদ্ধি গরার কিছু নাই আশায় আনে মনর বল নইলে জীবন টলমল আপদ-বলাই চাই নো আইয়ে গরীব মইধ্য তোয়াংগর দৃশ্যের বাস্তবতা আর বাস্তবতার কাব্যিকতা নির্মাণ সৈয়দ মহিউদ্দিনের এক সহজাত রূপদক্ষতা। আঞ্চলিক বুলিতেই যখন বলেন, ‘ভাংগা গাছত নয়া ঠেইল পাতা মেলি দেখার খেইল পংখি আবার উডের-ঘুরের চুপে প্রেমর কথা কঅর..' তখন দৃষ্টিপথে সাবলীলভাবে জেগে ওঠে ধ্বংসস্তূপের ওপর কর্মবীর আর অপারাজেয় মানুষের ডাগর মুখমণ্ডল। হতাশার করাল কুয়াশা ভেদ করা তাদের আশাদীপ্ত সৌন্দর্য। এ কাব্যিকতা সুদূরের কোনো বিমূর্ততা নয়, কষ্টকল্পনার ত্রাহি কোষ্ঠকাঠিন্য নয়। এ একেবারে সহজ-সুন্দরের নিটোল প্রতিমান। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার মতো। নদীর বয়ে চলার মতো। বিকেলের পর সন্ধ্যার অবতরণের মতো। আর রাতের নিবিড় সখ্যের মতো। অপরিকল্পিত নগরায়ণের দাপটে জনজীবনধারা থেকে হারিয়ে যেতে থাকা লোকায়ত মানুষের মাটিবর্তী ভাষা ও লব্জ, কাহিনি-কিংবদন্তি ও গানের ধারাকে আবার ঘরের আনাচ-কানাচে, আঙিনাজুড়ে সগৌরবে তার স্থানটি ফিরিয়ে দেওয়ার এক সুরেলা সেনাপতির নাম সৈয়দ মহিউদ্দিন। একালে, এখনকার বাংলাদেশে সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রাসঙ্গিকতা এভাবে, এখানেই।
Hafiz Rashid Khan- কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছেন। ১৯৯০ সাল থেকে পার্বত্য জীবন ও সংস্কৃতির ওপর সমুজ্জ্বল সুবাতাস নামে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে আসছেন চৌধুরী বাবুল বড়–য়ার সঙ্গে। পুষ্পকরথ তাঁর সম্পাদিত আরেকটি সাহিত্যের কাগজ। দুই সন্তানের জনক হাফিজ রশিদ খান চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এ কর্মরত আছেন। বাংলাদেশে বসবাসরত প্রাক জনগোষ্ঠীÑবিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনধারার ওপর তার কয়েকটি কাব্য ও গবেষণামূলক গ্রন্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার তরুণ-প্রবীণ সাহিত্যকর্মীদের সম্পাদনায় প্রকাশিত অনেক ছোট কাগজের বুকে অসংখ্য কবিতা মুদ্রিত হয়েছে তাঁর।