সে-রাত্রে আর ঘুম আসছিল না আমার। আমার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে বাবা কোনোদিন আমাকে একসঙ্গে এতকথা বলেননি। আমি তো কখনোই বলিনি। সেদিন রাত্রে এক পরিপূর্ণ স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে আমি মগ্ন-বিস্ময়ে ভ্রমণ করছিলাম।
উড়োজাহাজের স্বপ্ন নয়।
কিন্তু এই স্বপ্নেও টুকু ছিল। টুকু!
একটা পাহাড়ী জায়গায় প্রায় নির্জন বনভূমির কোল ঘেঁসে শালের খুঁটির ওপরে বাংলো প্যাটার্নের লাল টালি ছাওয়া বাড়ি। কাঠের সিঁড়ি লনে নেমে গেছে, শেষ ধাপটি আধো ঢাকা লম্বা লম্বা ঘাসে। লনের বাঁদিকে একটি ঝর্ণার স্রোত উত্তর দিকের কাঠের বেড়ার তল ঢুকে দক্ষিণদিকের বেড়ার তলা দিয়ে চলে গেছে হালকা কুয়াশার হিমে ঢাকা বনভূমির ভেতরে। সদ্য ভোরের হিমসিক্ত বাতাস বনভূমির বৃক্ষমূল ছুঁয়ে, ঝর্নার স্রোত ছুঁয়ে, বাংলোর বেড়া ছুঁয়ে দুটি ছোটো মাপের নিটোল পায়ের কাছে ঘাসে লুটোপুটি খাচ্ছে। লম্বা ঘাসের মধ্যস্থতায় এক-একবার বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে সেই পায়ের মধ্যমায় রক্ষিত রূপালি চুট্কিদুটিকে। পা দুটিকে ঘিরে রেখেছে হাল্কা ঘাস রঙের একটি সরু পাড়, পাড়ের উপর থেকে শাড়ির সোনালি স্ট্রাইপগুলো দ্রুতগতিতে ঊর্ধ্বে ছুটে গেছে। সামনের যে স্ট্রাইপগুলি দৃশ্যমান তার অধিকাংশই কিছু দূর উঠবার পর হারিয়ে গেছে কুচির ডানপাশে, বাঁপাশে, মধ্যিখানে। দূরত্ব ও অবস্থান অনুযায়ী তারা হেলে গিয়েছে কোনোটা ডাইনে অথবা কোনোটা বাঁয়ে। কাঁধ পর্যন্ত গিয়ে হারিয়ে গেছে গলার পাশ দিয়ে পিঠের দিকে। হেলানো স্ট্রাইপগুলি যাওয়ার সময় একটি ঢেউ.... ঢেউ... কাধের সেফটি পিনের বাঁধন ছাড়িয়ে মাটির সান্নিধ্যে... বিলীয়মান। টুকু? টুকুই তো!
ভোরের কুয়াশা-ছোঁয়া শুভ্রতার মধ্যে আকাশ আর আলোর যাবতীয় শুদ্ধতা মেখে লনের ডানদিকে গাছতলার বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে আছে। কী গাছ, নাম জানি না। কোন জায়গা, তা জানি না। টুকু এখানে কী করে এলো তাও জানি না। টুকুর চোখ নত হলেও ওর দুই ভ্রূর মাঝখানের বিন্দু-টিপটা দেখা যাচ্ছে। ওর হাতে উলের কাঁটা। টুকু উল বুনছে। লাল আর কালো উলের গোলার মাথা দুটি ঘাসের ফাঁক দিয়ে টুকু কোনোদিকে তাকাচ্ছে না, মুখ তুলে চাইছে না। অথচ ওর ঠোঁটে মৃদু হাসির আভাস। একবারও চোখ তুলে না তাকিয়েও আমাকে যেন দেখতে পাচ্ছে টুকু। কী করে যে টুকুরা দেখে! টুকু হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো, ডানদিকে সামান্য ঘুরল, হাতের বোনাটা রেখে দিল বসার জায়গায়। দু-হাতে কুচির দু-পাশ ধরে ঝাঁকিয়ে বিন্যস্ত করে নিলো। ঝুলে রইলো স্ট্রাইপসমূহ, পূর্বতন অবস্থানেই এলিয়ে পড়ল। টুকু কটিদেশের শাড়ির অবস্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে তেরছা স্ট্রাইপ, ঢেউ, কাঁধের জলপ্রপাত — সব ঠিক করে নিয়ে পা বাড়ালো ঝর্ণাবাহিত সোঁতাটির দিকে। বাঁ-হাতটিকে পরিপূর্ণরূপে আমার দিকে রেখে টুকু হেঁটে যাচ্ছে। ওর সাইড-প্রোফাইল দেখা যাচ্ছে— নাক-চোখ-মুখ, লম্বা ফর্সা গলা, গলা থেকে কুন্তীর ওপারের চালের মতো নেমে আসা কাঁধ, কটিদেশের শাড়ির ভাঁজে সামান্য কম্পন। টুকু হেঁটে যাচ্ছে। টুকু হেঁটে যাচ্ছে জলের সমীপে। আমি ইদানিং আর উড়োজাহাজের স্বপ্ন দেখিনি। অনন্যবর্তী দুর্লভ সূত্রধর