গানের কথা—বাংলার কথা ‘বাংলাদেশ গানের দেশ’-এই কথা বহু উচ্চারিত। তবে বাংলা গান-এর ভূগোল ও বিবর্তন নিয়ে নিবিড় পাঠমূলক প্রয়াস সমকালীন শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে একপ্রকার গরহাজির। সংগীতের তাত্ত্বিক পাঠের পরিসর বাংলায় খুব বেশি বিকশিত নয় আজও। ব্যক্তিগত গবেষণা, একাডেমিক প্রয়োজন, আর উপলক্ষের খেয়ায় ভেসে বিষয়ভিত্তিক অনিয়মিত প্রকাশনা মিলিয়ে যতটুকু কাজ হয়েছে তাতে বাংলা গানের একটা সুসংহত পরিচয় নির্মাণ এখনও কঠিন। বাজারে সংগীত বিষয়ক প্রকাশনাগুলোতে চোখ রাখলে দেখা যাবে অনেকগুলো তার কেবল লিরিকের সংকলন বা স্মৃতিকথা বা স্মারকগ্রন্থ। গান নিয়ে তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার পাশাপাশি কোন্ সামাজিক পটভূমিতে কোন্ গান তৈরি হচ্ছে তার অনুসন্ধানী প্রয়াস এখানে কম। এটা এক বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট। এর গভীরে গেলে দেখা যাবে, সংস্কৃতিচর্চা মোটামুটিভাবে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ফলে, সংগীত ক্রমে বিনোদনসর্বস্ব হয়েছে। পণ্যায়নের প্রভাবে নাগরিক উঠোনে নতুন নতুন সংগীতের ‘মহোৎসব’ চলছে। যেখানে প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের সংযোগ অপসৃয়মান। অথচ বরাবরই এই জনপদের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংগীতের সপ্রাণ উপস্থিতি ছিল। আজ তবে সাঁকো ভেঙ্গে গেল কোন পথে? ভাঙ্গন কি সাম্প্রতিক? ভাঙ্গনের সুর, অভিঘাত, বিবর্তিত পথরেখা নিয়ে শঙ্কা, হাহাকার উচ্চারিত হয়েছে � ��ের আগে। প্রসঙ্গত বলা যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রণীত ‘গানের বাহিরানা’ কতটা কদর পেল? বিশ শতক জুড়ে রাজনৈতিক পালাবদল, ঔপনিবেশিক যুগের অবসান, দেশভাগ, স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক-আন্দোলনের প্রভাবে বাংলা গান যেভাবে দিক বদলেছে তেমনি করে গ্রামোফোন রেকর্ড যুগের শুরু ও বিস্তার, রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশও সংগীতাংগনে নতুন হাওয়া এনেছে যার সবটা সুবাতাস নয় হয়তোবা। এতসব বাঁক পেরিয়ে কীভাবে, কতদূর এগোলো বাংলা গান, সে আলাপ কেন সুসংহত হল না, বাংলা গানের ইতিহাসটাই বা কেন রচিত হল না, বাংলাদেশপর্বে এসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংরক্ষণাগার, গবেষণা ও প্রসারমূলক উদ্যোগ জাতীয় পর্যায়ে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারল না কেন-এমন হাজারও প্রশ্নের গুঞ্জরণ থেকে ‘লেখালেখির উঠান’র এই ‘সংগীত সংখ্যা’র জন্ম। এ বিষয়ে, অন্তত বিগত দুই দশকে সংগীত, সংগীততত্ত্ব বা বাংলা গান নিয়ে সমকালীন পাঠের কিছু নমুনা পাবেন পাঠক। সাহিত্য পত্রিকার অঙ্গনে এরকম উদ্যোগ কমই চোখে পড়ে হয়তো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম সমগীত এর গণসংগীত আন্দোলন সংখ্যা, যামিনী’র সংগীত সংখ্যা। মাসিক সরগম বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে আলাদা। এরই মধ্যে বাজারে এসেছে সংগীত মনন। একই সময়ে হাতে আসা, কলকাতা থেকে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ, এবং জলার্ক, অনুষ্টুপ, বিতার্কিকা, তথ্যসূত্র, মিলেমিশে প্রভৃতি পত্রিকার সংগীত বিষয়ক সংখ্যা বাড়তি প্রেরণা ও ভাবনার যোগান দিয়েছে নিঃসন্দেহে। আর অনিয়মিত বিরতিতে নিবিষ্ট বেশ কয়েকজন গবেষকের কাছ থেকে বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি পাচ্ছি বটে তবে সামগ্রিক যে চিন্তা ও তৎপরতার বিকাশ জরুরি তার সমান্তরালে এসব নিতান্ত অপ্রতুল ও ব্যতিক্রম মাত্র। এই বৌদ্ধিক তৎপরতার অনুপস্থিতি কি শুধুই লেখালেখির ক্ষেত্রে? উত্তর, না। একটা সামগ্রিক বেপথু দশা চলছে পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গন জুড়ে। তারই উপজাত এটি, নইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষে ঢাকায় কোনোরূপ তৎপরতা দৃষ্ট হল না কেন? করোনা মহামারীর জন্য? বোধকরি না। সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে কি এই খরা কাটবে? রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী কিংবা লালন উৎসব ক্রমে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবশিত হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নও অমূলক নয় আজ। বিগত দুই দশকে এরকম উপলক্ষে এসেছে ঢের, তাতে উৎসবের বাদ্য উচ্চকিত হতে পারেনি। অথচ এখনও রাজপথের আন্দোলনে জনতা ঠিকই কণ্ঠ মেলায় ‘ও আলোর পথযাত্রী’ কিংবা ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে, এই জনতা’ গানে! অতএব, লেখালেখির উঠান আলাপের অবতারণা করল সংগীত নিয়ে এবং তা বাংলা গানকে কেন্দ্রে রেখে। বিপত্তি এখানেও। বাংলা গান কী? কতদূর বাংলা গান? কাদের গান? কবে থেকে বাংলা গান? এইসব চৌহদ্দি আঁকবে কে? কোথা থেকে শুরু হবে আলাপ? আবার গানেরই আছে শত ঘরানা-বাহিরানা! হাজার বছরে কত স্রোত এসে মিলেছে এইখানে। এই সব জিজ্ঞাসা গুছিয়ে আনতে এক গাদা বই লেখা যাবে! তবে গ্রামোফোন রেকর্ড যুগের বিকাশকে একটা বিন্দু ধরে ব্যক্তি, সমাজ ও সময়ের ইতিহাস পাঠের একটা শুরু তো হোক! বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রে সমকালীন পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষত ‘লেখালেখির উঠান’র প্রতিশ্রুতিমাফিক নবীন লেখকদের প্রতি পক্ষপাত ছিল। এই সংখ্যায় তাই প্রাজ্ঞজনের সাথে নবীন লেখকের জিজ্ঞাসা ঠাঁই পেয়েছে বেশি। বিষয়ের ঐক্য আর ঐতিহাসিক ধারাক্রম রক্ষা করা সম্ভবপর হয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বিষয়ের পুনরাবৃত্তি যথাসাধ্য এড়িয়ে গিয়েও অর্ধশতাধিকের বেশি বিষয়ে লেখা গ্রন্থবদ্ধ করার পরও অজস্র বিষয় বাদ পড়ে যাওয়ার পীড়া আমাদের সইতে হচ্ছে। বাংলা গানের দিগন্ত যাদের ছাড়া অকল্পনীয় তাঁদের অনেকের নামও বাদ রয়ে গেল। স্থানাভাব একটা কারণ বটে, তবে এসব বিষয়ে মানসম্মত লেখা পাওয়াটাও বড় সংকট হয়ে রইলো। এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেও লেখালেখির উঠান'র আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখকগণ আয়োজনটিকে একটা দৃশ্যমান বাস্তবতায় উপনীত করেছেন, এ কারণে আমরা কৃতজ্ঞ। ‘গানে জ্ঞান’। গানের সুরে ও স্বরে ভাবের আলাপ ও ভবের আলাপ বহমান স্থান থেকে স্থানে, এক যুগ থেকে অন্য যুগে প্রবাহিত। বাংলা গান তাই বাংলার ভাব, ইতিহাস আর মানুষের বয়ান। মার্গ সংগীত আর লোকায়ত গানের শরীরে বোনা আছে শ্রেণি সম্পর্কেরও ইতিহাস, শুধু নিবিড় করে তা পড়া চাই। দরবারী জলসা হতে উঠানে গানের আসরে পৌঁছোনোর কালে গানের মেজাজ ও চেহারা বদল হয়েছে যেমন করে, আজ রেকর্ড প্লেয়ারে, কনসার্টে কিংবা টেলিভিশনে গান পরিবেশনকালে পালিশ চলছে নানান কায়দায়, নানান মতলবেও। এইসব সমীকরণ সরল নয়। আধুনিক-অনাধুনিক, শ্লীল-অশ্লীল, কেন্দ্র-প্রান্ত এইসব অজস্র বাইনারি ক্রিয়াশীল আছে বাজারে এবং বাইরেও। ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, শুদ্ধচারিতার জিকির যেমন আছে তেমনি আছে ‘গেঁয়ো’, ‘অশিক্ষিত’ বর্গকে নাক সিঁটকানোর প্রবণতা। এর মাঝে বিগত শতকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পপ সংগীত। ব্যান্ড সংগীত তরুণদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। তথাকথিত মূলধারার সাথে কোথায় যেন একটা ঘোর বিরোধকাল যাচ্ছে! এদিকে কর্পোরেটতন্ত্র এখন গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক, ফলে কেন্দ্রবদলটা ঘটছে নানা প্রান্তে--যা ঠিক সুষম, সুবিন্যাস্ত না হলেও একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা। সরকারি অর্থায়নে বিভিন্ন কনসার্টের জয়জয়কার কিংবা কোক স্টুডিও, রিয়েলিটি শো ইত্যাদি ঘিরে উন্মাদনা, নিউ মিডিয়ায় ভিউ কালচার এখন নতুন ফেনোমেনন। এরই সমান্তরালে কবীর সুমন কিংবা অঞ্জন দত্তের কনসার্ট ঘিরে ঢাকায় প্রবল আগ্রহ, উদ্দীপনা নতুন করে ভাবায়, বাংলা গানের ভূগোল এখনও কাঁটাতারের সীমানার চেয়ে ঢের বেশি বিস্তৃত! এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে আলাপটুকু সীমায়িত করেছি আমরা মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত ধারাটিকে কেন্দ্রে রেখে। তবে আলোচনার সূত্রেই কেন্দ্র থেকে বিপ্রতীপ কোন বিন্দুতে আলো ফেলার সুযোগ অবারিত ছিল স্বাভাবিকভাবেই। ড. নূরুল আনোয়ারের বিশদ এবং দুর্লভ তিনটি রচনাকে লেখালেখির উঠান-এর পক্ষ থেকে পরিমার্জিতরূপে হাজির করেছেন অজিত দাশ। কামালউাদ্দন কবীরের রচনায় ‘বাংলার গীতরঙ্গ’ এর পরিচয় পাঠের প্রস্তাবনা শুধু সংগীত নয় বরং এই জনপদের সংস্কৃতির নমুনা পাঠের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনা তৈরি করেছে ইতোমধ্যে। ড. জিনবোধি ভিক্ষু’র রচনা ফিরিয়ে নিয়ে যাবে একবারে বাংলাগানের প্রাকপর্বে। ভক্তি আন্দোলনে গান কতটা কৃত্য আর ভাবের বাহন, শিখধর্মের আলোকে তারই সূত্রসন্ধান করেছেন মুহাম্মদ তানিম নওশাদ। সংগীতের ভাষা সার্বজনীন, পাঠের সূত্রটিও তাই কোন এক ভাষা বা জনপদের গানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। এই বিবেচনায় সংগীততত্ত্বমূলক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ সাঈদ হাসান খান, গৌরাঙ্গ হালদার, তাসনিয়া ইসলাম। একইসাথে পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জীর সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন রাফসান গালিব। কলিম শরাফী’র দুর্লভ সাক্ষাৎকারের রেকর্ড দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন কুররাতুল-আইন-তাহমিনা। ‘নজরুল ও অজয় ভট্টাচার্য : সাংগীতিক পরম্পরা’ শীর্ষক রচনায় মাসুদ রহমান ‘অজয় ভট্টাচার্য’কে আলাপে হাজির করে আমাদের দায়মুক্ত করেছেন। তবে বিস্মৃতির অতলে এমনি আরও অনেক প্রিয় নাম আড়াল হয়ে লজ্জা দিচ্ছে! ‘বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা’ বাংলাদেশের তরুণদের কাছে নতুনভাবে হাজির হবেন নিশ্চয়ই। আসামের চর চাপরির লোক সংগীতও আমাদের জন্য চেনা সুর নয়। কবি ফরহাদ মজহার ও পালাকার সুনীল কর্মকারের আলাপচারিতা, ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, আব্দুল আলীম, ভূপতি ভূষণ বর্মা এবং কৃপাসিন্ধু রায় সরকারের সাক্ষাৎকার এই সংখ্যার উজ্জ্বল সংযোজন। রাজনীতির গান বা গানের রাজনীতি পাঠের চর্চা বিরল প্রায়। অথচ গণসংগীতের উজ্জ্বল ইতিহাস আছে বাংলা গানে। বিগত শতকের উত্তাল চল্লিশ, গণনাট্য সংঘ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে সাম্প্রতি আন্দোলনের গানের কথা উঠে এসেছে কঙ্কণ ভট্টাচার্য, প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী, অমল আকাশ, শামীম আমিনুর রহমান, বীথি ঘোষ প্রমুখের রচনায়। বিষয় বিবেচনায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘সুন্দরবন আন্দোলনের গান : প্রবণতা ও দিশা’ রচনাটি লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে পুনর্মুদ্রিত হল তবে স্থানাভাবে বিস্তৃত তথ্যসূত্র বর্জিত হল বলে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের সংগীতের ইতিহাস যেন বিলুপ্তির ইতিহাস, এত এত মণিমাণিক্য হারিয়েছি আমরা তা হিসাব করা মুশকিল। বিলুপ্তির কিছু চিহ্ন পাঠ করেছেন রঞ্জনা বিশ্বাস, রুখসানা কাজল, সুকন্যা দত্ত, সেলিম মণ্ডল, নিরুপমা রহমান, পাভেল পার্থ, সিলভানুস লামিন প্রমুখ। বাংলাদেশে অন্য ভাষাভাষী মানুষের সংস্কৃতির প্রতি আমাদের আগ্রহ বরাবরের মত জারি থাকল। এই সূত্রে অশ্রুত অনেক গানের কথা প্রামাণ্য আকারে সংকলিত হল এই সংখ্যায়, এটা বিশেষ তৃপ্তির বিষয়। অজস্র গুণী সংগীতকার, ভাটিয়ালি, কীর্তনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারার সংগীত অনালোচিত থাকলেও স্বল্পশ্রুত বা প্রায় অপঠিত ধারার সংগীত, গীতিকবি সম্পর্কিত রচনা বাংলা গানের স্বরূপ পাঠে নতুন রসদ যোগাবে নিশ্চয়ই। মোস্তাক আহমাদ দীনের স্বাদু গদ্যে ‘ফকির ইয়াছিনের আত্মপরিভ্রমণ’, শিল্পী আকাশ গায়েন এর বয়ানে ‘বাউল আবদুর রহমান’ পরিচয়, আসিফ আল নূর এর লেখায় ‘মজলিশপুর হাওরে মরমি অনুরণন: মামুদ জান’, ওয়াহিদ সুজন এর রচনায় ‘উকিল মুন্সী’ এবং বঙ্গ রাখালের রচনায় ‘পাগলা কানাই’ লোকায়ত গানের এক অসীম ভুবনের সন্ধান মিলবে। মরমি, বিচ্ছেদি, ভাব গান বাংলা গানের অমূল্য সম্পদ অথচ বড্ড অনাদরে আছে। মাইজভান্ডারি গানের প্রাকপর্বের গীতিকবিদের পরিচয় এবং তাঁদের কীর্তির নমুনা পাঠে দাউদুল ইসলামের আন্তরিক প্রয়াস আমাদের সামনে হাজির করেছে অশ্রুত ইতিহাস। কবিয়াল বিজয় সরকার, সাধক মনমোহন দত্তের আলাপেও এসেছে বাংলার ভাবান্দোলনের জমিন। লোকায়ত এই সংগীত যেমন প্রায় ব্রাত্য হয়ে আছে, নগরের জনপ্রিয় ঘরানার গানও একাডেমিক আলাপে তেমনি ব্রাত্যপ্রায়। নইলে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে জীবন্ত কিংবদন্তী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনের সংগীত চর্চা কোন ডিসকোর্স আকারে হাজির নেই কেন? আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির এবং আসলাম আহসানের রচনায় এই প্রশ্নের কিঞ্চিৎ মুসাবিদা রইলো। থিয়েটারের সংগীতের আয়োজন একটু ভিন্নরকম বটে, তবে উপস্থাপনের ধরনে-করণকৌশলে নয়। শুভাশিস সিনহার রচনায় তাই নাট্যজন এস এম সোলায়মানের গোলাপজান নির্মাণ বহুস্তরিত পাঠের অবতারণা করে। নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী এবং শিল্পী দেবলীনা ঘোষের বয়ানে থিয়েটারের সংগীতের আদ্যোপান্ত উঠে এলো স্বকীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। নানাভাবেই বলছি যে গান জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির গল্প বহন করে। আহমেদ বাবলু এবং রজত কান্তি রায়ের ভিন্নধর্মী লেখায় একবারে ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা পাবেন। যে খামতির দিকে দৃষ্টিপাত করানোর প্রয়াসে উপরের যাবতীয় আলাপের সূত্রপাত, অর্থাৎ সংগীত বিষয়ক পাঠের সামাজিক প্রস্তুতি এবং প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে নজর ফেরানো- তার অন্তত একটি সমাধানমূলক প্রস্তাব উঠে এসেছে কাবেরী সেনগুপ্তা’র লেখায়। সামগ্রিকভাবে বিগত শতকে বাংলা গানের চলনটিকে প্রতিনিধিত্বশীল চিহ্ন পাঠের মাধ্যেমে বোঝাপড়ার প্রাথমিক প্রয়াস এই সংগীতসংখ্যা। যতটুকু আলোচনা উঠে এসেছে তা সমুদ্র হতে এক কলস পানি তুলে আনবার মত হলেও সংগীতের শ্রোতা, পাঠক এবং শিল্পী সকলের নিকট একটা বৌদ্ধিক আলাপের বিস্তার ঘটাবে বলে আমাদের অনুমান। পাঠকগণ অধ্যাপক আহমদ শরীফের লালন শাহ্ প্রবন্ধটি পাঠ করে ঋদ্ধ হবেন এ আশায় এটি পুনর্মূদ্রণ করা হলো। ছাপা সংস্করণের ধারাবাহিকতায় অনলাইনে এ বিষয়ে মতামত, প্রতিক্রিয়া বা নতুন তর্কের জমিন খোলা রইলো। আমরা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ৪র্থ ও ৫ম সংখ্যা যৌথ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করলাম। সংগীত সংখ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল লেখক, শিল্পী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।