উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারদের হাতে রাষ্ট্রনায়কদের জীবনহানি বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন কোন ঘটনা। নয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম পৃথিবীর । ইতিহাসে আর কোন রাষ্ট্রনায়ককে এমন নিমর্মভাবে সপরিবারে নিহত হতে হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, যে সকল সামরিক অফিসাররা এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিল তারা কেউ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও ছিল না। সামান্য ‘মেজর' পদবীর লোকজনই বলা চলে একরকম বিনা বাধায় একটি দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার পরিবারের সকল সদস্যসহ হত্যা করতে সমর্থ হয়। হত্যাকান্ড পরিচালনা করতে তারা ব্যবহার করে ট্যাঙ্ক, যে ট্যাঙ্কে কোন গোলাবারুদও ছিল না। দেশের একজন রাষ্ট্রপতি বাস করতেন বলা চলে একেবারেই প্রহরাবিহীন, দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা শুধু বিরল নয়, অসাধারণও মজার ব্যাপার হল, একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার কর্তৃকই বাংলাদেশে প্রথম সামরিক আইন জারীর ঘোষণা আসে। দেশে দেশে সামরিক বাহিনী অনেক হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছে শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্যে, বাংলাদেশের ১৫ আগষ্টের কালরাতের হত্যাকাণ্ড ক্ষমতার জন্যে পরিচালিত হয়নি, এই জঘণ্য ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল একটি দেশের জন্মের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নিতে। বাংলাদেশের জন্ম যারা মেনে নিতে পারেনি তারাই এই হত্যাকান্ডের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এই খুনীরা শুধু অসভ্য ছিল তা নয়, তারা ছিল বর্বর, জংলী এবং পশুর চেয়েও অধম। একজন শিশু কিংবা নববধুও। মাতাল এসব খুনীদের অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তারা এতোটাই উলঙ্গ চেহারার ছিল যে, দেশে তারা আইন তৈরী করেছিল যে খুনীদের বিচার করা যাবে না। এমন আইন আবার জাতীয় সংসদে পাশ করেছিল সামরিক শাসকদের কুকুর হতেও গর্ববোধ করে এমন কতিপয় সংসদ সদস্য-রাজনীতিকরা। দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এর চেয়েও বেশি অসভ্যতা আর কি হতে পারে! বঙ্গবন্ধুর জীবনে ট্র্যাজেডি অনেক। আপন করে বড় করে তুলেছিলেন যে সেনানায়কদের, বিপদের দিনে তারা কোন কাজে আসেনি। অন্তত: যেসব বাহিনী গড়ে তুলতে পারতো প্রতিরোধ, তারাও সময়ের ডাকে সাড়া দেয় নি। সব থেকে অপদার্থ হিসেবে বেরিয়ে এসেছে তার।
রাজনৈতিক অনুসারীরা, যারা কঠিন প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়াতে পারতো, তারা কেউ কেউ বঙ্গন্ধুর রক্তের দাগ না শুকাতেই শুধুমাত্র একটুখানি মন্ত্রী হতে সুড়সুড় করে খুনিদের সাথে হাত মিলিয়েছে, অন্যরা পালিয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়ে একদিক থেকে ভালই করেছিলেন, এর ফলে তাঁর নিজের এতো কাছের অপদার্থদের নিয়ে তাঁর বেশিদিন চলতে হয় নি। দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জন্যে এটা সত্যি ট্র্যাজেডি যে পরিবারের সদস্য হিসেবে এসব দৃশ্য তাদের দেখতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার ঘটনার পর যেসব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তা ছিল সাহসিক। যেসব সংগঠন ও সংগঠক এসব প্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছিলেন তারা সময়ের সাহসী সন্তান। ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টাকে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
ড. মোহাম্মদ হাননান বাংলাদেশের তরুণ নিষ্ঠাবান ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে অন্যতম, যিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাসটি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে ধরতে পেরেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি এই ঢাকা শহরে অতি, কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী ঘটনাবলী। একজন কিশোর হিসেবে সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। তাই দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়টি তার কাছে একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হিসেবেই ধরা পড়েছে। এই গ্রন্থে পাঠক বিচারের রায়ের সাথে এর ইতিহাসের বিভিন্ন দিক, খুটি-নাটি পড়ে প্রকৃত সত্যকে অনুধাবন করতে সমর্থ হবেন। এখানেই এই বিষয়ক অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে এই গ্রন্থটির পার্থক্যকে স্পষ্ট করেছে।
ড. মােহাম্মদ হাননান সহস্রাব্দ ও শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইত্যাদির ওপর যে। সংগ্রহ-সংকলনটি করেছেন তা অনুসন্ধিৎসু যে-কোনাে পাঠকের কাছেই বিশ্বকোষের স্বাদ এনে দেবে। শতাব্দীর বাংলাদেশ, শতাব্দীর বিশ্ব, সহস্রাব্দের বাংলাদেশ, সহস্রাব্দের বিশ— গ্রন্থ চারটিকে নানাভাবেই সাজানাে যায়। এখানে পাঠক বাংলাদেশকে পাবেন দু’ভাবে-শতাব্দী ও সহস্রাব্দের মতাে করে, আবার বিশ্বকেও পাবেন শতাব্দীর পাশাপাশি সহস্রাব্দের পটভূমিতে। শতবছর অথবা হাজার। বছরের পরিক্রমায় বাংলাসমাজ ও বিশ্বসমাজ এভাবেই গ্রন্থ চারটিতে মূল্যায়িত হয়েছে।