গতকাল সন্ধ্যায় আমার মা মারা গেছেন। আজ সন্ধ্যা অব্দি তাঁকে সমাহিত করা হয়নি একটাই কারণে, আমরা বাবার জন্য আপেক্ষা করছিলাম। মা'র মৃত্যুর পর গতরাতের গভীরে সবার উচ্চকিত ক্রন্দন যখন থিতিয়ে এসেছে, নেমে পড়েছিলাম পথে, খুব সন্তর্পণে, মৃত বাড়ির আলুথালু বিপন্নতা পেরিয়ে। কেন যে আমি গলা ছেড়ে না কেঁদে ওরকম একটি কাজ করেছিলাম, এখন পর্যন্ত এর মর্ম উদ্ধার করতে পারিনি। কেবল অনুভব করছিলাম চারপাশের আর্তনাদমিশ্রিত আতরের ঘ্রাণ আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে অসহ্য শীত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আমার মৃত্যু দশা হতে শুরু করলে খাটিয়ায় রাখা মা'র মৃতদেহ পাশ কাটিয়ে ঢেউ খেতে খেতে রাস্তায় গিয়ে পড়েছিলাম। আমার মা মারা গেছেন বলে পাড়ায় কারও বাড়ির বাতি জ্বলা বন্ধ ছিলো না। লম্বা নির্জন গলিটার মধ্যে কয়েকটি আঁধার বৃক্ষ ছিলো। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ হেঁটে আমি সেই বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকাই। শীতের থুথুড়ে বাতাস আবছা আধো ছায়ায় পাক খেতে খেতে আমার সমস্ত রোমকূপে অসহ্য কম্পন ঢুকিয়ে দেয়। এতোক্ষণে টের পাই, আমার শরীরে খুব পাতলা একটা কাপড় লেপটে আছে। আমি গভীর নির্জন রাতে হু হু শীতে কাঁপতে কাঁপতে দূর থেকে দেখছিলাম আমাদের বাসাটি, যেখানে কুয়াশাবাতির নিচে নিশ্চল শুয়ে আছেন আমার মা।
নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। একজন বাংলাদেশী লেখক, ঔপন্যাসিক, এবং সাহিত্য সম্পাদক। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তার বাবা গোলাম আম্বিয়া ফকির ছিলেন সরকারী চাকুরিজীবী ও মা উম্মে সালমা ছিলেন গৃহিণী। বাবার চাকরীর কারণে থাকতেন মামাবাড়িতে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তাকে আর তার ভাইকে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের এক মামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ভর্তি হন শানকিপাড়া স্কুলে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য থাকতেন ফুফুর বাড়িতে। ফুফুর এক মেয়ে ছিল শবনম জাহান। ফুফু তার নামের সাথে মিল রেখে মা-বাবার দেয়া নাম নাসরীন সুলতানা পরিবর্তন করে তার নাম রাখেন নাসরীন জাহান। স্কুলে পড়াকালীন পারভিন সুলতানা নামে এক বন্ধুর সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে। সে বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়-এ ভর্তি হলে তিনিও একই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৭ সালে শিশু একাডেমি থেকে লেখা চাওয়া হলে দুই বান্ধবী লেখা পাঠায়। দুজনের লেখা প্রকাশিত হয় সেই পত্রিকায়। ব্যক্তিগত জীবনে নাসরীন জাহান কবি আশরাফ আহমেদের স্ত্রী। লেখালেখির সূত্রেই তার সাথে পরিচয় এবং সে থেকে প্রণয়। ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের এক মেয়ে। নাম অর্চি অতন্দ্রিলা। নাসরীন জাহান পাক্ষিক পত্রিকা অন্যদিনের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।