"রাজনৈতিক কবিতা" বইটির ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থে শামসুর রাহমান দেখা দিয়েছিলেন নিভৃতিপ্রিয় আত্মমগ্ন মৃদুকণ্ঠ স্বপ্নচারী কবি হিসেবে। এদেশে তখন সবে সামরিক শাসনের সূচনা হয়েছে। সেই কঠোর যাতাকলে আমাদের প্রিয় মূল্যবােধগুলি যখন একের পর এক গুড়িয়ে যেতে লাগল, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তার কাছ থেকে পাওয়া গেল এমন সব কবিতা যাকে রাজনৈতিক বললে দোষ হবে না। এ রাজনীতি দলের নয়, দশের; এ কবিতা স্লোগানের নয়, মর্মঘাতী ব্যঙ্গের, অব্যক্ত যন্ত্রণার, তীব্র ভালােবাসার। সেই থেকে শামসুর রাহমান আর ফিরে তাকান নি। যেখানেই স্বৈরশাসন, সেখানেই তিনি প্রতিবাদী; যেখানেই মানুষের সংগ্রাম, সেখানেই তিনি সঙ্গী। সমাজ ও পরিবেশের প্রতি কোনাে সৎ ও বিবেকবান লেখক উদাসীন থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন না। “শিল্প হলাে পৃথিবীর উদ্দেশে সুলিখিত পত্ররচনা”– চার্লি চ্যাপলিনের এই উক্তি উদ্ধৃত করে একটি রচনায় শামসুর রাহমান বলেছেন, 'হ্যা, তবে সেই পত্রে থাকতে হবে দেশ ও মানুষকে বাঁচানাের মন্ত্র, সকল পশুশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার। শামসুর রাহমান সেই অঙ্গীকার করেছেন দীর্ঘদিন আগে। তাই গণ-অভ্যুত্থানে ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেমন শরিক হন কবিতা নিয়ে, তেমনি স্বাক্ষর দেন রাজনৈতিক বিবৃতিতে, স্বৈরাচারের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন সরকার-নিয়ন্ত্রিত দৈনিকের প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে। জীবন, মনুষ্যত্ব ও শ্ৰেয়ােবােধের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে যে-বাণী তিনি উচ্চারণ করেন, তাতে ধ্বনিত হয় বিবেকের কণ্ঠস্বর। গত পঁচিশ বছরে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থগুলাে থেকে বাছাই করা কবিতার এই সংকলনে ধারণ করা হয়েছে সেই স্বর। এই সংকলন পড়ে মনে হবে, অননুকরণীয় ভঙ্গিতে অনিন্দনীয় শৈলীতে পাঠককেই প্রশ্ন করেছেন দেশের প্রধান কবি: ‘অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার? আনিসুজ্জামান
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।