বর্ণপরিচয় আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই সংস্করণে কোনও কোনও অংশ পরিবর্ত্তিত হইয়াছে; সুতরাং সেই সেই অংশে পূৰ্ব্বতন সংস্করণের সহিত অনেক বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইবে। প্রায় সৰ্ব্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে, বালকেরা অ, আ, এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ, বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা, সেরূপ না বলিয়া, কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক। যে সকল শব্দের অন্ত্য বর্ণে আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ এই সকল স্বরবর্ণের যোগ নাই, উহাদের অধিকাংশ হলন্ত, কতকগুলি অকারান্ত, উচ্চারিত হইয়া থাকে। যথা, হলন্তকর, খল, ঘট, জল, পথ, রস, বন ইত্যাদি। অকারান্ত—ছোট, বড়, ভাল, ঘৃত, তৃণ, মৃগ ইত্যাদি। কিন্তু অনেক স্থানেই দেখিতে পাওয়া যায়, এই বৈলক্ষণ্যের অনুসরণ না করিয়া, তাদৃশ শব্দ মাত্রেই অকারান্ত উচ্চারিত হইয়া থাকে। বর্ণযোজনার উদাহরণস্থলে যে সকল শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে, তন্মধ্যে যে গুলি অকারান্ত উচ্চারিত হয়, উহাদের পার্শ্বদেশে * এইরূপ চিহ্ন যোজিত হইল। যে সকল শব্দের পার্শ্বদেশে তদ্রূপ চিহ্ন নাই, উহারা হলন্ত উচ্চারিত হইবে। বাঙ্গালা ভাষায় তকারের ত, ৎ, এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় কলেবরের নাম খণ্ড তকার। ঈষৎ, জগৎ, মহৎ প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ লিখিবার সময়, খণ্ড তকার ব্যবহৃত হইয়া থাকে। খণ্ড তকারের স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত, বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার শেষভাগে তকারের দুই কলেবর প্রদর্শিত হইল।
Iswar Chandra Vidyasagar- তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বীরসিংহ সেই সময় অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ছিলেন সুপণ্ডিত ও বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা পুরুষ। ইনিই ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় চাকুরি করতেন। পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের অতীত ছিল। সেই কারণে বালক ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী ও ঠাকুরমার সঙ্গে বাস করতেন।উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রথম জীবনেই তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি ছিল তাঁর। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ করে তোলেন ও অপরবোধ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। রচনা করেছেন জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয় সহ, একাধিক পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ। সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহু রচনা। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। বিধবা বিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তাঁর অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরিত হয় যথোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনই তাঁর দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরে যেত না। এমনকি নিজের চরম অর্থসংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। তাঁর পিতামাতার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভক্তি ও বজ্রকঠিন চরিত্রবল বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী কলকাতার আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিদ্যাসাগর সেতু তাঁরই নামে উৎসর্গিত। জন্ম গ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন "ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়"। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। তিনি ২৯ জুলাই ১৮৯১, ৭০ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।