ভূমিকা উনিশ শতকের নবজাগরণের অরুণ-আলোয় উদ্ভাসিত বাংলা গদ্যশিল্পের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর কালীপ্রসন্ন সিংহ এর ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা' (১৮৬১ খ্রি.)। পাশ্চাত্যের সাহিত্যরস আত্মস্থ করে মাইকেল মধুসূদন সমাজ-সমালোচনার মাধ্যম হিসাবে যখন হাতে তুলে নিচ্ছেন প্রহসনের তরবারি, একই পরিমণ্ডলে পুষ্ট; কালীপ্রসন্ন'র লেখনী একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে নক্শার তীক্ষ্ণশর। নক্শার মধ্যে লেখকের ব্যবহৃত একটিমাত্র শব্দ দিয়েই আমি চেষ্টা করেছি রচনাটির অন্দরমহলে ঢোকার, আর সেটি হল –‘আরশি’। বাংলার নবজাগরণ প্রসঙ্গে আমরা যেখানে মূলত রামমোহন-বিদ্যাসাগরের উন্নতমনা সংস্কারের কথাই মনে রাখি, সেখানে কালীপ্রসন্নর এই নক্শার আরশিতে আমরা দেখলাম, সেই কলকাতারই নাগরিক অবক্ষয়ের এক ভিন্ন কদর্য রূপ, দেখলাম হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা ‘বাবু কালচার’-এর অধোগতির বিপরীতে চোরাস্রোত, তাছাড়া এই নক্শার ভাষাশৈলীর দর্পণে আমরা দেখলাম, ভবিষ্যৎ বাংলা গদ্যের সার্থক চলন, রামমোহন বিদ্যাসাগরের সাধু গদ্যের প্রতিস্পর্ধী চলিত ভাষার দৃপ্ত চ্যালেঞ্জ। · কালীপ্রসন্ন'র পরে নক্শা রচনার ধারা অব্যাহত থাকলেও অতি-আধুনিক পাঠকের কাছে আজো বাংলা নক্শার সার্থক উদাহরণ ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা।' কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রন্থটির ওপর আলোচনা তেমন নজরে আসে না। এই বিস্মৃতির বেদনা থেকে উদ্ধার করে রচনাটিকে আরেকবার পাঠকের সামনে উপস্থিত করার সামান্য প্রয়াস এই গ্রন্থে। প্রকাশক শ্রীদেবাশিস ভট্টাচার্য সেই প্রয়াসের অন্যতম অংশীদার। এছাড়া যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য ছাড়া এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হত না, তাদেরও ধন্যবাদ জানাই। সর্বোপরি, গ্রন্থটি যদি ‘হুতোম’ সম্পর্কে আজকের পাঠকের মনে সামান্যতম ঔৎসুক্য জন্মাতে পারে, তবে আমার পরিশ্রম সার্থক বিবেচনা করব।