দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড লিগ্যাসি অব মোসাদ প্রাগৈতিহাসিক যুগের পর মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে, তখন থেকেই গুপ্তচরবৃত্তির চর্চা প্রকাশ্যে আসে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সেই গুপ্তচরবৃত্তির কাজটাই করে। তবে পাল্টেছে কাজের ধরন, পরিধি ও চর্চা। ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি হচ্ছে এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার কাজ হলো নিজ দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, গবেষণা ও সেগুলো নিরাপদে রাখা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কাজ করতে হয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি রয়েছে। তবে গোপনীয়তা ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাগিরির চর্চায় কয়েকটি সংস্থা ছাড়িয়ে গেছে অন্য সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে। মোসাদ এরকমই একটি সংস্থা। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর সংস্থা হিসেবে গণ্য করা হয় ইসরায়েলের মোসাদকে। প্রচণ্ড গোপনীয়তার কারণে মোসাদ সম্পর্কে বেশির ভাগ তথ্যই অজানা। এরপরও বিশ্ব মিডিয়ায় নানা সময় মোসাদের সাথে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় উঠে এসেছে। মোসাদ প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন মনে করতেন, গোয়েন্দাগিরি ইসরায়েলের First Line of Defence। টার্গেট দেশ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সন্ত্রাস দমন ও অপারেশনের বিষয়াদি গোপন রাখা হচ্ছে মোসাদের প্রধান কাজ। ইসরায়েলের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যক্রমের রিপোর্ট ও গোয়েন্দা তথ্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়; নীতিমালা ও কার্যক্রম অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, যুক্তরাজ্যের MI-6 ও কানাডার CSIS (Canadian Security Intelligence Service)-র অনুরূপ। মোসাদের হেডকোয়ার্টার ইসরায়েলের সাবেক রাজধানী তেল আবিবে অবস্থিত। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঠিক সংখ্যা কেউ না জানলেও এর সংখ্যা কম করে হলেও সহস্রাধিক হবে। অবশ্য ১৯৮০ সালের শেষদিকে এ সংখ্যা ২০০০-র বেশি ছিল। মোসাদ সামরিক বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তর নয়, যদিও অধিকাংশ কর্মকর্তা IDF (Israel Defense Forces)-র। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ৬৯ বছর পুরানো। আর গণনা করা হয়, ২,০০০ বছরেরও বেশি ইতিহাসে এই দ্বন্দ্বের শিকড় রয়েছে। এত দীর্ঘ সময় ও ইতিহাসের সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া জটিল ও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে, যার মধ্যে রয়েছে কোয়ার্টেট, প্যালেস্টাইন অথরিটি, ফাতাহ, হামাস আর আরব লীগ ও ইসরায়েলের মতো পক্ষগুলো। এসব ধারণার মধ্যে রয়েছে প্রত্যাবর্তনের অধিকার, সংলগ্ন সীমানা, সুরক্ষিত সীমানা, অ-সামরিক অঞ্চল ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে, এমনকি পরিশীলিত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও অনুসারীদের জন্যও বিষয়টির ওপর নজর রাখা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সৃষ্টির পর প্রথম দশকগুলোতে ইসরায়েল অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয় কারণ সর্বোৎকৃষ্ট ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অধিকারী হওয়া কার্যত প্রয়োজনীয় ছিল। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই, মোসাদ ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত সংস্থা। হিব্রুতে, মোসাদের অর্থ ‘ইনস্টিটিউট', তবে Mossad-র পূর্ণরূপ হলো Merkazi le-Modiin 9 ule-Tafkidim Meyuhadim। এর অর্থ হলো- 'Central Institute for Intelligence and Special Operations'। বর্তমানে ১০টি পৃথক বিভাগ নিয়ে মোসাদের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়নের নেতৃত্বে মোসাদ গঠিত হয়। মোসাদের ভাষ্য হলো, 'আমাদের রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই শত্রু দিয়ে বেষ্টিত। গোয়েন্দা সংস্থা হলো First Line of Defense... আমাদের চারপাশে কী ঘটছে, তা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে।' এরপর থেকে মোসাদ বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং একইসঙ্গে নির্মম ও রহস্যময় ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোসাদকে অবিশ্বাস্য উদ্ধার অভিযান, সহিংস হত্যাকাণ্ড ও শত্রু দমন অপারেশনের চতুর নাশকতার 'কৃতিত্ব' দেওয়া হয়েছে। পৈশাচিক বা অপরিহার্য যা-ই হোক না কেন, মোসাদের সমালোচক ও সমর্থক উভয়ই স্বীকার করেন, মোসাদের আনুমানিক ১,২০০ কর্মচারীর অনিশ্চিত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অনন্য সক্ষমতা রয়েছে। সীমিত রিসোর্স দিয়ে তারা বৃহৎ উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে। প্রত্যাশা দমে গেলেও তারা অবিচল থাকে। দ্য মোসাদ (The Mossad: The History and Legacy of Israel's National Intelligence Agency) বইটি সংস্থার সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য, ঐতিহাসিক সূচনা, স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি ও স্নায়ুযুদ্ধের সাম্প্রতিক প্রভাবকে তুলে ধরেছে নির্মোহভাবে।
মোসাদ ১ম ফ্ল্যাপের লেখা আমেরিকার সিআইএ বা রাশিয়ার কেজিবিও নয়; ইংল্যান্ডের MI-6, ভারতের RAW কিংবা পাকিস্তানের আইএসআই-ও নয়। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক, নিষ্ঠুর ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থার অপর নাম মোসাদ। ১৯৪৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইসরায়েলের কথিত প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়নের হাতে মোসাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেন গুরিয়ন ছিলেন জায়নিজমের কট্টর হোতা এবং ইজরায়েলে হিব্রু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা প্রদানকারী। ১৯৭২ সালে Black September নামক ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীরা মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ১১ জন ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদকে হত্যা করে। ঐ কর্মকাণ্ডে জড়িত একজন ফিলিস্তিনি বিদ্ৰোহী বাদে অন্যদের বিভিন্ন দেশে গিয়ে গুপ্তহত্যা করা ছিল মোসাদের লোমহর্ষক অপারেশন। কয়েকজন হামাস নেতাকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে মোসাদের বিরুদ্ধে। পত্র-বোমা পাঠিয়ে হত্যা করার কৌশল প্রথম আবিষ্কার করে মোসাদ। এছাড়াও ইরাকের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়া এবং ইরানের দুজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করার তথাকথিত কৃতিত্ব (?) রয়েছে মোসাদের। সব মিলিয়ে মোসাদ ইসরায়েল রাষ্ট্রের ফুসফুস; দেশের ভরসা ও শত্রুদের সাক্ষাৎ যমদূত। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বাঁচানোর জন্য ইসরায়েল যেভাবে আয়রন ডোম ব্যবহার করে, তেমনি মোসাদ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষায় ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই মোসাদ ছাড়া ইসরায়েলের অস্তিত্ব কল্পনা করা এক দুঃস্বপ্ন। ব্যাক কভারের লেখা কোনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিই ইসরায়েলের মোসাদের মতো রহস্যজনক নয়। সিআইএ-র ভাষ্যমতে, 'মোসাদ হলো বিশ্বসেরা'; মোসাদ দম্ভ করে বলে, মোসাদে বিশ্বের সবচেয়ে অনুগত ও দেশপ্রেমিক এজেন্ট রয়েছে। মোসাদই উল্লেখযোগ্য উদ্ধার অভিযানের মাধ্যমে এন্টেবে থেকে ইসরায়েলি জিম্মিদের ছাড়িয়ে এনেছিল। মোসাদ এজেন্টরা ইসরায়েলি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের টার্গেট হিসেবে শনাক্ত করেছিল, যাতে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লি উড়িয়ে দেওয়া যায়। ইসরায়েলি এজেন্টরাই আর্জেন্টিনায় অ্যাডলফ আইচম্যানকে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করেছিল। তাকে ইসরায়েলে নিয়ে এসে হলোকাস্টের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল। ১৯৪০-র দশক থেকেই ইসরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে মোসাদ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রথমবারের মতো রোনান্ড পেইন মোসাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেছেন। পড়তে থ্রিলারের মতো মনে হলেও প্রতিটি তথ্যই সত্য ও বাস্তব। বইটি বীর, খলনায়ক, ইন্টেলিজেন্সের মাস্টার এবং অপহরণ, নাৎসি অনুসন্ধান, উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন এসপিওনাজ, পারমাণবিক অস্ত্র চোরাচালান ও বিদ্রোহ দমনে অপারেশনের কাহিনি দিয়ে পরিপূর্ণ। গ্র ন্থ কা র প রি চি তি 🍂 রোনাল্ড পেইন ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও যুদ্ধকালীন সংবাদদাতা, যিনি গুপ্তচরবৃত্তি ও সন্ত্রাসবাদের ওপর মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯২৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ধর্মমন্ত্রী। পকলিংটন গ্রামার স্কুল ও বেডফোর্ড স্কুল থেকে পেইন পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি Royal Marines-এ চাকরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জেসুস কলেজে ভর্তি হন।