মতিয়া চৌধুরীর দীর্ঘ স্মৃতিরচনা 'দেয়াল দিয়ে ঘেরা।' লেখাটি শুধু ব্যতিক্রমী বললে কিছুই বলা হলো না। অবিস্মরণীয় বটে। ষাটের দশকের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী মতিয়া চৌধুরী, যাঁর আগুন ঝরানো বক্তৃতা স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের গদি কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তাঁর কারাজীবনের স্মৃতিকথা অবশ্যই গুরম্নত্বপূর্ণ। কিন্তু না, এই দীর্ঘ লেখাটিতে কোথাও সেই অগি্নকন্যার রাজনৈতিক জীবনালেখ্য প্রধান প্রসঙ্গ হয়ে ওঠেনি। সাতষট্টি সালে সামরিক সরকারের বিরম্নদ্ধে ভয়ংকর 'আপত্তিকর' বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে মতিয়া চৌধুরী গ্রেফতার হন। ময়মনসিংহের জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে তাঁকে আটকে রাখা হয়। এই লেখায় তাঁর সেই জেলজীবনের অভিজ্ঞতা মুখ্য বিষয় বটে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তিনি এখানে থেকেও নেই। জেলখানার ভেতর নারীবন্দীদের জন্য যে আলাদা সংরৰিত সেল, সেখানে সেসব বন্দিনীরা বছরের পর বছর ধরে যে নারকীয় জীবনযাপন করে আসছে, তারই মর্মস্পর্শী প্রতিচিত্র এঁকেছেন লেখিকা। উপেৰা, অত্যাচার, প্রহার, বঞ্চনা, জমাদারনীর সন্ত্রাস, এসবের মধ্যে পশুর অধম অমানুষ হয়ে বেঁছে আছে ওখানকার মেয়েগুলো। ওদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মানসিক -ভাবে বিকারগ্রসত্ম। প্রতিটি নারী কয়েদির বিড়ম্বিত জীবনদশা আলাদা আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। পরিশীলিত ও দরদি পর্যবেৰণে এই ভয়াবহ নরকগুলজার বর্ণনা করেছেন লেখিকা। বাইরে মুক্ত জীবন। অবারিত আলো-বাতাস। স্বাভাবিক ছন্দে গতিশীল দিন-রাত। আর ওখানে চার দেয়ালের পিঁজরাপোলে পূতি গন্ধসর্বস্ব ঘেয়ো পচা কৃমিজীবন। একেবারে নির্মোহ চোখে দেখেছেন মতিয়া চৌধুরী। রাজনৈতিক মঞ্চে যাঁর জ্বালাময়ী কণ্ঠ উত্তেজিত করে তোলে শত শত শ্রোতাকে, এখানে সে ঝাঁঝ সংযত। ফলে পৰপাতের ওজর ওঠার উপায় নেই। ডিভিশনের আসামি হয়েও কৌলিন্যের অভিমানে এই ব্রাত্যদের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র দূরত্বে সরিয়ে রাখেননি তিনি। বাম রাজনীতির মূল ভিত্তি যে মানবমুক্তির সাধনা, সেই দীৰা তাঁর ভেতরটাকে এভাবেই আলোকিত করেছে। কোথাও শিৰিতের আভিজাত্যবোধ বা বিরোধী রাজনীতির অভ্যসত্ম প্রতিবাদী স্বর ফাউ-ইগোর আরোপণ ঘটায়নি। অত্যাচারী কর্তৃপৰ ও অত্যাচারিত কয়েদি, উভয়পৰ থেকে সমীহ ও আস্থা অর্জন করেছেন। কয়েদিরা তাঁকে সালিশ-মধ্যস্থ মেনেছে। ওদের দুঃখ-দুর্দশা নিবৃত্তির জন্যে সুপারিশ করেছেন কর্তৃপক্ষের আছে। জীবনের এমন দুঃসহ চিত্রের ঘনিষ্ঠ মানবিক উদ্ঘাটন।