"ক্বেবলা ও সালাত" বইটির প্রাক্কথন অংশ থেকে নেয়াঃ আমাদের তরিকাপন্থী দলীয় লােকদের জন্য এই পুস্তিকা লিখিত হইল। ইহা একটি দলীয় পুস্তিকা, যদিও মােহাম্মদী ধর্মে দলাদলি থাকিতে পারে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। ইহাতে 'ফজরের নামাজ’ নামক যে অংশ আছে তাহা একটি দীর্ঘায়িত ব্যবস্থা। আমরা তাহাজ্জাদ করিবার সময়ে নিদ্রিত থাকিবার অভ্যাসে আবদ্ধ হইয়া গিয়াছি। এইজন্য ফজরের নামাজ’ নামে লিখিত যে ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে তাহার সঙ্গে ‘তাহিয়াতুল অজু’ দুই রাকাত সালাত জুড়িয়া দেওয়া হইল এবং সালাত শেষে একটি অজিফা পড়িবার ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে যাহাতে ব্যবস্থাটি একটু দীর্ঘ হয়। ইহা তাহাজ্জাদ পালন না করিবার অপরাধের মাশুলস্বরূপ রহিল। যদিও আমরা চিশতিয়া তরিকার নিজামিয়া শাখার অন্তর্ভুক্ত অতি ক্ষুদ্র একটি দল তথাপি মােহাম্মদী ধর্মের মধ্যে বিচ্ছিন্ন কোনরূপ দল সৃষ্টি করিবার আইনসঙ্গত সুযােগ আছে বলিয়া বিশ্বাস করি না, কারণ সত্যিকার মােহাম্মদী ধর্মে দ্বিমত থাকিতে পারে না। মােহাম্মদী শরিয়তের পায়বন্দী ব্যতীত উম্মতে মােহাম্মদী হওয়া যায় না। তরিকাভুক্ত হওয়া অর্থই দ্বীনে মােহাম্মদী হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হওয়া। অথচ দ্বীনে মােহাম্মদী হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলিয়া কোরানে ঘােষণা করা রহিয়াছে। সুতরাং, তরিকার মধ্যে মোহাম্মদী শরিয়ত কিছু থাকিলে তরিকা একেবারেই অসার হইয়া পড়ে। অপরপক্ষে মােহাম্মদী শরিয়ত পুরাপুরি বহাল রাখিতে পারিলে তরিকা সৃষ্টি করিবার কোন প্রয়ােজনই থাকিত । এলমে এলাহি দ্বারা কালামে এলাহিকে বুঝিতে হইবে এবং হেকমতে এলাহি দ্বারা হুকুমে এলাহিকে আমল করিতে হইবে। এই শিক্ষা রসুল (আ.) এবং তাঁহার আহলে বাইত ব্যতীত আর কাহারও নিকট হইতে প্রাপ্তব্য নহে। যে বা যাহারা অত্যাবশ্যকীয় ধর্মীয় আইনের মােটামুটি জ্ঞান অর্জন করিয়া উহা বিশ্বাসপূর্বক কার্যে পরিণত করেন না তাহারা এই প্রবন্ধ কয়টি পাঠ করিলে নিজেদের ইমান ও আখেরাত নষ্ট করিয়া ফেলিবেন। কাজেই কেহ যেন এইরূপ না করেন অনুরােধ করিতেছি। কেবলা : বস্তুভিত্তিক কাবাঘরটি অথবা আকসা মসজিদ ঘরটি কেবলা নহে বরং আদর্শভিত্তিক এবং ভাবভিত্তিক মসজিদুল হারাম এবং মসজিদুল আকসা হইল মানুষের কেবলা। সালাত : সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে-ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা দ্রষ্টব্য ৭০ : ২২-৩৫)। ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য। সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করা : সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করিবার ব্যবস্থা হিসাবে আনুষ্ঠানিক পাঁচবেলা বাধ্যতামূলক এবং ভােররাত্রের একবেলা তাগিদমূলক সালাত পালনের ব্যবস্থা রসুলাল্লাহ (আ.) প্রদান করিয়া গিয়াছেন, যেন মানুষ তাহার সারাদিনের কর্মগুলিকে আল্লাহর এবাদতে রূপান্তরিত করিয়া তুলিতে পারো মুসল্লি হওয়ার জন্য কোরান মজিদে দায়েমি সালাতের নির্দেশ দিতেছেন। কাজেই ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত না হইলে সরকারী কর্মচারীগণ দায়েমি সালাত পালন করিয়া মুসল্লি হইতে পারেন না। ইহার কারণ যে সময়টুকু তাহারা সরকারের কাজে লিপ্ত থাকিবে সেই সময়টুকু সালাতরূপে গণ্য হয় না এবং তাহা আল্লাহর এবাদতরূপে গণ্য হয় না; যতকাল সমগ্র কর্ম এবাদতরূপে গৃহীত না হয় ততকাল মুসল্লিরূপে এবং সৎকর্মশীল দাসরূপে আল্লাহ গ্রহণ করেন না। সালাতের আমল দ্বারা আত্মদর্শনের যে গভীরতা অর্জন করা যায় তাহা নিজের মধ্যে কার্যকরী করিবার পদ্ধতির একটি নমুনা মাওলা হােসাইনের (আ.) প্রার্থনার মধ্যে এবং সুফির দৃষ্টিতে আল কোরানের ব্যাখ্যার যে নমুনা আমাদের প্রকাশিত কোরান দর্শন (১ম, ২য় ও ৩য়) খণ্ডে প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহাতে সালাতের মাধ্যমে আত্মদর্শনের পদ্ধতির কিছু পরিচয় পাওয়া যাইবে। যে বিশিষ্ট সাধু, পণ্ডিত এবং হৃদয়বান ব্যক্তি হইতে এই পুস্তিকা রচনায় সাহায্যপ্রাপ্ত হইয়াছি এবং ইহা প্রকাশের প্রেরণা লাভ করিয়াছি সেই মহাত্মা আল্লামার স্মরণে। কোরান মজিদ রহস্যময় বাণীর সমষ্টি। ইহার কথা বুঝাইবার যােগ্যতা নবী এবং ইমামগণ ব্যতীত আর কাহারও নাই। তাহাদিগকে নেক নজরে তাহারা যাহাকে যতটুকু বুঝিবার শক্তিদান করেন তিনি ততটুকু মাত্র বুঝিতে সক্ষম হইয়া থাকেন। এমতাবস্থায় কোরানের তফসির লিখিবার অধিকার আর কাহার আছে? নবী এবং ইমামগণ ব্যতীত কোরানের ব্যাখ্যা ও বয়ান করিবার অধিকার কাহারও নাই। যাহারা লােকদিগকে বুঝাইবেন তাহারা ইমামগণের কথার মূলভিত্তির উপর ব্যাখ্যা করিবার অধিকার পাইবেন মাত্র। তথ্য এবং তত্ত্বকে বদলাইয়া নূতন করিয়া কিছু বলিতে পারিবেন না। সুতরাং, ইমামগণের নির্দেশিত সঠিক পথ ব্যতীত অন্যপথে নিজেদের খেয়াল খুশীমত কোনরূপ ব্যাখ্যা লিখা ঘােরতর অপরাধ এবং তাহা কেন? আল্লাহ এবং তাঁহার প্রতিনিধিস্থানীয় মহান ব্যক্তিগণ বুঝাইয়া যাইতে পারেন নাই বলিয়াই আমাদের স্বাধীন ব্যাখ্যার প্রয়ােজন হইয়া দাঁড়াইয়াছে-এমন কথা মানিয়া লইলে সত্যের অপলাপ হইবে। নবীর (আ.) বংশধর ইমামগণ আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে আজীবন কোরানের তফসীর বয়ান করিয়া গিয়াছেন-কথায় এবং কাজে। কিন্তু উহা আমাদের কাছে আসিয়া পৌছিতে পারে নাই। উমাইয়া এবং আব্বাসীয় রাজশক্তির চক্রান্তে রাজশক্তি দ্বারা বিকৃত ভাবধারা রচিত হইয়া তফসির নামে আমাদের নিকট আসিয়া পৌছিয়াছে। এই বিকৃত মতবাদসমূহ পরবর্তী রাজশক্তিগুলি গ্রহণ করিয়া তাহা আরও বর্ধিত এবং বহুমুখী করিয়া লইয়াছে। এইজন্য তফসির জগতে মতভেদের এত ছড়াছড়ি। কোরানের সত্য উদ্ধার করা বর্তমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে সম্ভব নহে। এমন একটিও খাঁটি তফসির পুস্তক আমাদের নাগালে নাই যাহার উপর নির্ভর করিয়া নির্ভুল তথ্য ও তত্ত্ব পরিবেশন করা যাইতে পারে। তবু ইমামপক্ষীয় আলেমগণ হইতে বিক্ষিপ্ত দুই-চার কথা যাহা পাওয়া যায় তাহাকেই অবলম্বন করিয়া প্রবন্ধ কয়টি পরিবেশিত হইল।