ভূমিকা আবু বকর নাদিম তরুণ কবি। প্রবল কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে ভোর বেলা ঘুম ভাঙ্গা-চোখ খুলে যা দেখেন, সারাদিন-রাত যা তাকে ভাবনায় ফেলে দেয়, তার সব কিছুই নাদিমের কবিতার বিষয়। সৌন্দর্য তার চোখ এড়ায় না। তাই সুন্দরের দেখা মিললে তা কবিতা হয়েই আসে তার কাছে। যেমন আসে সমস্যা-সংকটও। তাই তার কবিতায় বিষয় বৈচিত্র্যের দেখা মিলবে বেশ। তবে তরুণ এই কবি লক্ষ্যহীন নন। বরং তার কবিতার মূলে আছে কল্যাণ চিন্তা, মানুষ ও পরিবেশ উভয়েরই কল্যাণ চিন্তা। নাদিম স্বভাব কবি। কবিতা অন্তঃপ্রাণ মানুষ। তাই তিনি কবিতার সঙ্গে চলেন। কবিতাও তাকে সঙ্গ দেয়। তাগিদের মধ্যে রেখে দেয়। মনে হয় যেন, তিনি কবিতা লিখেন না, কবিতাই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। ফলে কবিতা থেকে তার মুক্তি নেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে মোরগের ডাক কানে আসলেই কবিতা তার মনে উঁকি দেয়। পাখির কল কাকলির সঙ্গে কবিতার শব্দ ভেসে আসে। ঘর থেকে বের হয়ে এই যে ধুলো ওড়া জনপদ, সবুজ বৃক্ষরাজি, মানুষ কিংবা সমাজের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন, সবকিছুতেই কবিতার দেখা পান তিনি। তাই কবিতা তার মূলত পারিপার্শ্বিকতার পর্যবেক্ষণের সামগ্রিক ফল। তবে শুধুই ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরার লেন্স দিয়ে হুবহু ছবি তুলে উপস্থাপন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নন আমাদের কবি। বরং সমাজ-জীবন-জগত-মানুষ সবকিছু নিয়ে তার স্বপ্ন আছে, আলোকিত দর্শন আছে, বিশেষত পরিবেশের প্রতি আছে প্রতিশ্রুতি এবং ভালোবাসা। সেজন্য পরিবেশের প্রতিকূল যেকোনো কর্মকাণ্ড যেমন তাকে ব্যথিত করে, পরিবেশের স্বপক্ষে কোন অবস্থান কিংবা মতামত প্রকাশ তাকে ভালোলাগা দেয়। তাই নাদিমের কবিতায় মানুষ যেমন আছে, পরিবেশ আছে একই রকম গুরুত্ব নিয়ে। আর আছে মানুষের রুচি-বিবেচনা-বিবেক পরিশুদ্ধ করার প্রবল ইচ্ছে ও প্রতিজ্ঞা। তাই কবিতায় সৌন্দর্য চর্চার পাশাপাশি সংস্কারকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হন নাদিম। তার কবিতা পাঠ করলেই একে একে হাজির হবে এই রকম বিচিত্র বিষয়। কালো বর্ণের মানুষের দুঃখ কবি বোঝেন, হয়তো চারপাশে এরকম অনেক কালো মানুষের মনের বেদনার সঙ্গে পরিচিত তিনি। তাই মানুষের আড়-চোখ, আর অবজ্ঞার বিপরীতে প্রশ্ন তোলেন কবি, “বিষণ্ণ আর অন্ধকার আমিও এক মানুষ/চামড়া কালো,কৃষ্ণাঙ্গ এটাই কি আমার বিরাট দোষ?” না, দোষ যে নয়, তা কবি একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে জানেন বলে মানুষের বিবেচনা বোধের সংশোধন চান, সমাধান দেন এইভাবে শিক্ষক-সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, “হোক সে কৃষ্ণাঙ্গ, পঙ্গু, ভঙ্গু, বর্বর অন্ধ/যদি থাকে পরিপাটি মন নহে সে মন্দ।“ আর এই সবের দেখা মিলবে তার “কৃষ্ণাঙ্গ” কবিতায়। এই রকম আরও কবিতা আছে যেমন “বিলিয়ে দাও”। হাত পাতা মানুষকে, দুঃখীজনকে না ফেরানোর পরামর্শ দিয়েছেন কবি। তরুণ এই কবির চোখ মানব মানবীর সম্পর্ক, সংকটের মধ্যে আবদ্ধ নয়। চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ তাকে ভাবায়। পরিবেশ বিনাশী-আত্মঘাতী-মানুষের কর্মকান্ডে লজ্জিত বোধ করেন তিনি। তাই আক্ষেপ-প্রতিবাদে কবি উচ্চারণ করেন, “জঙ্গল কুঞ্জের গাছ কেটে মানুষ করলো ক্ষয়!/কেন?/কেন মানুষ বনের বৃক্ষ উজাড় করে ক্ষয়?” আর সেই পরিবেশ ধ্বংসের ভুক্তভোগী কোকিলের কান্নায়, পাখিদের দুর্দশায় কবির আর্তনাদ, “আমি থাকিতে পারিনি সইতে, মানুষ হয়ে লাজে চাই যে মরিতে”। তরুণ কবির এই পরিবেশবাদী উচ্চারণ আছে “কোকিলের আর্তনাদ” কবিতায়। শৈশবে ফিরে দেখার একটা চিরন্তন ইচ্ছে সবার থাকে। এই কবিরও আছে। তবে তা আঁকবার জন্য প্রকৃতির কোলে ফিরে গেছেন কবি “আমার শৈশব” কবিতায়। পল্লী জীবনের অনুষঙ্গের সঙ্গে মিলিয়েছেন মধুর শৈশবকে, “কত স্বাধীন, কত মুক্ত জীবন/সহজ,সরল পল্লীর প্রতিটি মন।/বৃক্ষের রঙ কত গাঢ়, কি কচি নির্মল বায়ু!”। ঠিক যেন কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর প্রকৃতি-শৈশব ঘেরা রোমান্টিকতা! “পাখি উড়ে” কবিতায় শৈশব ঘেঁষা রোমান্টিকতা এবং পাখির সঙ্গে সখ্য করবার আয়োজনের দেখা মেলে। পাখি নিয়ে ভিন্ন ভাবনা পাওয়া যাবে “পাখির কাছে প্রশ্ন আমার” যেখানে প্রকৃতি আর মানবীয় প্রেমের অদ্ভুত এক সংশ্লেষ চোখে পড়ে। এই ধারায় আলস্যের বন্দনা করেছেন কবি “অলস ছেলে” কবিতায়। “মা'র স্মৃতি” কবিতাটি যে কারও অনুপস্থিত মাকে হাজির করে দেয়। মার জবানিতে মায়ের উচ্ছল-উজ্জ্বল শৈশব-কৈশোরের বর্ণনা হাজির করেছেন কবি, এবং মাকে খুঁজে পান তাঁর হাঁটা পথে কারণ “মা'র হেটে যাওয়া পায়ের চাপ এখনো ধবল দুধের মতো” স্পষ্ট তার কাছে। গ্রামীণ জীবনের অনেক না-জানা বেদনার গল্প থাকে, সেই সব গল্প মর্মস্পর্শী। কর্মক্ষম, মেধাবী হয়েও শিক্ষা জোটে না আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে। তারপর ভাগ্য ফেরাতে “সংসারের অভাবে সে ছেলে হঠাৎ জমালো বিদেশ পাড়ি/তারপর কখনো মিলেনি খোঁজ, ফিরেনি আর কখনো বাড়ি।“ এ যেন জীবনের পাঁকে অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া মানুষদের থেকে বেছে নেয়া এক গল্প। পড়তে পড়তে বুক ভারী হয়ে আসে। ছোট ছোট কবিতা আছে কিছু। সেগুলি বেশ কৌতুক উদ্দীপক এবং শক্তিশালিও বটে, যেমন, “চৌঠা” কবিতার তিন লাইন, এরকম, “তোমাকে শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর দেখার/দণ্ডনীয় অপরাধে,/শাড়ি তোমার জন্য নিষিদ্ধ করা হল।“ লুকোচুরির এইসব প্রেমের চাষ ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, কিশোরে চাঁদের মুখোশে কিরণ ছড়াতে ছড়াতে পুরো পবিত্র/ কেউ জানেনি,চোখের ভেতর আছে প্রণয়ের কবিরাজি মন্ত্র। তার লুকোচুরির মীমাংসা কবিতায় দেখা পাবেন । এইভাবে ভাবনা-দর্শন-পর্যবেক্ষণের বীজ বুনে বুনে আবু বকর নাদিম লিখেছেন এই বইয়ের কবিতাগুলি। তরুণ এই কবির কবিতা যাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হোক। তার জন্য শুভ কামনা।
আবু বকর সিদ্দিক নাদিম ২০০১ সালের ২২ ই মে জন্ম, কুমিল্লা, নাঙ্গলকোট উপজেলার, পৌঁছির গ্রামে। দারুন্নাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে, বর্তমানে গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যায়নরত।