লকডাউন ২০২০ মেয়েদের বঞ্চনার কপালে জুড়ে দিয়েছে এক নতুন রেখা। দুর্ভাগ্য ও হতাশার দিনলিপিতে জায়গা করে নিয়েছে অস্তিত্বের সংকট। মেয়ে হয়ে জন্মানোর এক চিরকালীন সংকটে সাথি হয়েছে লকডাউনের বিপন্নতা। বীরভূমের মিলির কথা দিয়েই শুরু করা যাক। এক যুগের বেশি রমরমিয়ে চলছে কাঁথাস্টিচের প্রতিষ্ঠান। লকডাউনে এতদিন ধরে সেখানে কর্মরতা প্রায় দুশো মেয়ে হঠাৎ বেকার হয়ে পড়বে, তাই এতগুলি সংসার বাঁচাতে মিলি চালিয়ে যায় কাজ। ওদের বাঁচাতে বিক্রি করতে হয় নিজের গয়না। মুর্শিদাবাদের কাঁথাস্টিচ কাজের আর-এক শিল্পী বিলকিস রাবেয়াকে ঘরে পড়ে-থাকা শাড়ির পাহাড় কমাতে নিতে হয় সোশ্যাল সাইটে বিক্রির আশ্রয়। পাটের কাজ করে লায়লা। তাকেও বাক্সবন্দি জিনিস নিয়ে মেলার অপেক্ষায় নিদ্রাহীন অপলক রাত কাটাতে হয়। ব্যাগ তৈরি করে ডলি, সেও গুনতে থাকে অপেক্ষার প্রহর। মেদিনীপুরের পরিযায়ী শ্রমিক সন্ধ্যারানি দিল্লিতে হঠাৎ কাজ হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। বর্ধমানের বাসন্তীও লকডাউনে ভিনরাজ্যে স্বামীর আটকে পড়ায় দিল্লিতে বসে কপর্দকশূন্য দিন কাটাতে থাকে। কুচবিহারের প্রতিমা মোদক কাপড়ের ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ায় দিল্লিতে বসে সন্ধান করতে থাকে একবেলার খাবারের। প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষার আলোতে মুখ দেখতে না-পাওয়া পানসারিরাও চায় নিজের উপার্জনে বাচ্চার দুধ কিনতে। বাসন্তীরা চায় নিজের কপালের টিপের পাতাটার জন্যও কারও কাছে হাত না পাততে। বিড়িবাঁধার কাজে নিযুক্ত শ্রমিক কালন চায় নিজের পয়সায় মাথার উপর ছিঁড়ে যাওয়া প্রতিবছরের প্লাস্টিকটাকে একবার স্থায়ী করতে। পরিযায়ী শ্রমিক রিম্পা চায় স্বামীর দিন খেটে টাকা আনার আশায় না বসে, সকাল সকাল নিজের হাঁড়িতে ভাত বসাতে। মহিলাদের নিজের হাতে চাই পরিবারের ও নিজের খরচ চালানোর মতো কিছু নগদ পয়সা। উপার্জনের জন্য চাই আত্মবিশ্বাস। আত্মনির্ভরশীল জীবনের খোঁজে আয়নার মুখোমুখি নিজের ক্ষমতার মুখটুকু মিলিয়ে দিতেই আমার বেরিয়ে পড়া। প্রান্তিক মেয়েদের স্বপ্ন ও সাধ পূরণের সেই আলাদিনের প্রদীপটি খুঁজে এনে হাতে দেওয়া। নিজের উপার্জন খুঁজে ফেরার ইচ্ছাটাকে জাগিয়ে তোলা। ওদের জীবন গ্লানিমুক্ত হোক। নিজের ঈশ্বর নিজেই হয়ে উঠুক। সমান ও উপযুক্ত সুযোগের দ্বন্দ্ব পেরিয়ে যাক সহস্রবার। আর দরকার লকডাউনের মতো অপ্রত্যাশিত আচমকা বিপদের দিনে মাথায় রাষ্ট্রের শক্তিশালী হাত। লকডাউনে লবণ দিয়ে ভাত খাওয়া বালিকা কিস্কুদের ঘরে প্রদীপ জ্বলুক। প্রদীপের তেল ও সলতে হোক পাটের কাজে নিমগ্ন শিল্পী লায়লাদের উপার্জনের আত্মগর্বের সাক্ষী। শেষপর্যন্ত এটুকুই প্রত্যাশা।