এক ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ এবং সাংগীতিক চারিত্র্য প্রতিকবাদী কবি পল ভেরলেন-এর কবিতার প্রধান লক্ষণ। আর তাই তাঁর কবিতাকে বাংলা ভাষায় দেখা অতিশয় জরুরি হয়ে উঠলো, কেননা ভেরলেন-এর কবিতার মৃদু গুঞ্জন পাঠকের হৃদয়ের গভীরে যে মিলনমুহূর্তের প্রতিধ্বনি জাগায় সেটাই তার আসল আকর্ষণ। প্রাক্কথন পল ভেরলেন তার দ্বন্দ্বমুখর সময়ে ফরাসি কবিদের মধ্যে বিচিত্রমুখী আধুনিক কবি ছিলেন। বলা যায় উনিশ শতকের আধুনিক শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম একজন তিনি। প্রতীকবাদীতা তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ প্রতীকবাদী আন্দোলনের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে পল ভেরলেন-এর কবিসত্তা। উনিশ শতকের সত্তর দশকে ‘প্রতীকবাদী’ আন্দোলনের প্রথম আদর্শ কবি হিসাবে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। ৩০ মার্চ ১৮৪৪-এ উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের মেজ শহরে জন্ম নেয়া কবি পল ভেরলেন তার দুরন্ত ও মাত্রাহীন অসংযমী জীবনের সঙ্গে প্রতিভাশালী এক কবিশক্তির স্ফুরণের পাশাপাশি যেমন খ্যাতি পেয়েছিলেন তেমনি দুর্নামও কুড়িয়েছিলেন বেশ। তার চেয়ে বয়সে ছোটো তরুণ কবি জাঁ আর্তুর র্যাঁবো-র সাথে উথালপাতাল সর্ম্পকের দরুণ সরলপথে চলেনি তার জীবন। আবসাঁথ, পাগলামি ও উন্মত্ততায় শেষ হয় স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া। কেননা আট-দশজনের জীবন তার নয়। নিজের শর্তে তিনি বেঁচেছেন। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা লোকভয় তাকে নিরস্ত করতে পারেনি সামান্য পরিমাণেও। ভেরলেন একটি গদ্যে নিজেদের অভিশপ্ত কবি বলেছেন- কেননা সমাজ মেনে নেয়নি তাদের। তার কবিতা নতুন চিন্তাস্রোত তৈরি করেছে। বিজ্ঞান সহায়তা করেছে নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন করে। অপ্রকাশ্য, সীমাহীন ও রহস্যঘেরা মনোজগৎ প্রকাশে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। আধ্যাত্মিকতাও কবিতাতে উঠে এল দার্শনিক চেতনায়। অথচ সামাজিক দৃষ্টিতে কোনো শুদ্ধতর জীবনযাপনের জন্য জন্মাননি ভেরলেন। জাঁ আর্তুর র্যাঁবো-র জন্য তার স্ত্রী-সন্তান-সংসার ছেড়েছেন। অথচ র্যাঁবো-কে গুলি ছুঁড়েছেন তিনি তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে। আর এই গুলি লাগে র্যাবো-র কবজিতে। আর এ জন্য তাকে দুবছর জেল খাটতে হয়েছে। এই সময় জেলে বসে পল ভেরলেন লিখলেন ‘সাজেস’ (জ্ঞান) বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা। এই কবিতায় ভেরলেন নিজেকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষার পরিচয় দিয়েছেন। তার মনে হয়েছে কষ্টই তাকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। ভেরলেন তার স্বপ্নালু দৃষ্টির গভীরতা দিয়ে দেখেছেন ব্যথাতুর খ্রিস্টকে। কিন্তু পুনরায় তিনি ছুটে গিয়েছেন র্যাঁবো-র কাছে। র্যাঁবো জানিয়েছেন- “ সেদিন ভেরলেন স্ট্যুটগার্টে এসেছিল হাতে জপমালা নিয়ে, কিন্তু ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সে তার প্রভুকে অস্বীকার করেছে এবং আমাদের পুণ্যাত্মা প্রভুর আটানব্বইটি ক্ষত থেকে আবার রক্ত ঝরেছে।” শেষদিনগুলো কেটেছে মদ্যপান, উচ্ছৃঙ্খলতা, অনাচার, নারীসংসর্গ, হাসপাতাল ও দারিদ্র্যের মধ্যে। কিন্তু কবি হিসেবে মানুষের ভালোবাসাও কম পাননি। প্রতিভার অপচয় করেছেন- জীবন কাটিয়েছেন বিব্রতকর মানসিক অস্থিরতায়। সুরের ঝংকার, আবেগের উত্তাপ, বিষাদের উচ্ছ্বাস, কখনও অশালীনতা, কখনও আধ্যাত্মিকতা পল ভেরলেন-এর কবিতাকে অপরূপ রহস্যে মণ্ডিত করে তুলেছে। অনুভূতির সঙ্গে বারবার মিশে গেছে সংগীত। তার কবিতায় তিনি নিজের জীবনের কোনো দিক গোপন করার চেষ্টা করেননি। নিজের কবিতায় নিজের হৃদয়কে তিনি অনাবৃতভাবে মেলে ধরেছেন। শব্দের উচ্ছ্বাস কিংবা অলংকারের বাহুল্য কবিতার পক্ষে ক্ষতিকর বলে তিনি মনে করতেন। স্বভাব কবির মতো তিনি স্বতঃস্ফূর্ত কবিতায় বিশ্বাস করতেন। গীতিকাব্য যে কত স্বাভাবিক ও মর্মস্পর্শী হতে পারে, কত স্বতোৎসারিত, তা তার কবিতা পড়লে অনুভব করা যায়। ৮ জানুয়ারি ১৮৯৬-এ পৃথিবী ছেড়ে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া এ কবির কবিতা ‘শান্ত, সুন্দর, বিষণ্ন’, ঠিক যেভাবে একটি কবিতায় তিনি চন্দ্রালোকের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তার কবিতাকে ধরেছেন নিঃশব্দ অথচ বেদনার্ত সুরে, যা অনেক সময়ই প্রেমের, যার অনুরণন পাঠকের হৃদয় ও স্নায়ুতে স্পর্শ দিয়ে যায়। তার কবিতার প্রেম রোম্যান্টিক কবিদের নয়, অভীপ্সায় তা আধুনিক এবং বিষণ্নতা তার অন্তর্লীন সুর। তার কবিতা অজস্র চিত্রকল্প তৈরির পাশাপাশি ধ্বনিময়তার আবেদনেও সমানভাবে শ্রবণীয়। ধ্রুপদি কবিতার আঙ্গিক ব্যবহারে অতি দক্ষ তিনি। আর তাই কবি হিসেবে পল ভেরলেন অসামান্য ও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছেন ফরাসি কবিতার জগতে। শাহিন লতিফ দুলাল বাড়ি, কাজির শিমলা ত্রিশাল, ময়মনসিংহ