সময়ে প্রয়োজনে মহাপরাক্রমাশীল বীর মুঘলদেরকেও একদিন বিদায় নিতে হয়েছে এই ভারতবর্ষ থেকে। যে পথে এসেছিলেন মহাবীর বাবর, সে পথেই ধূর্ত ইংরেজরা ভারত থেকে বের করে দেয়, তাড়িয়ে দেয় ভারতবর্ষের সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে। নির্বাসনে পাঠায় বার্মায়-রেঙ্গুনে। কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত মাটি মেলেনি জাফরের। বার্মায় চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। মুঘল শাসনব্যবস্থার কৃতিত্ব, ত্রুটিবিচ্যুতি ও দোষগুণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে সর্বশেষে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এটি ছিল জনকল্যাণময় ও জনহিতৈষী শাসনব্যবস্থা। মুঘল সম্রাট আকবরকে ‘মহান শাসক’ বলা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল বিশাল, আকবরের সময় সর্বপ্রথম এই সাম্রাজ্য চারিদিকে বিস্তৃতি লাভ করে, কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময় এর বিস্তৃতি হয় সর্বাধিক। মুঘল শাসনের অবসানে ব্রিটিশ আমলে উঠতি ধনী লোকেরা ব্যতীত গোলামি থেকে মুক্তি চেয়েছে সবাই। তাতিয়া টোপি, আজিমুল্লাহ, লক্ষ্মী বাই, হজরত মহল অবন্তি বাই, কুয়ার সিং, আহমদউল্লাহ-কত নাম, ক্ষুদিরাম, চন্দ্র শেখর আজাদ, ভগত, প্রীতিলতা, সূর্যসেন কত প্রান্তের মানুষ! এক হয়ে সবাই অবিচল ছিল একই লক্ষ্যে। ভারতের নীলের ওপর ভিত্তি করেই ১৭৪০ থেকে ১৮০২ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিশ্বে নীলের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করেছিল। ইংরেজ ধনিকরা বুঝলেন নীল ও পাট ইত্যাদি বাণিজ্য-ফসল বাংলার মাটিতে ফলাতে পারলে প্রচুর লাভ। বাংলার দরিদ্র চাষি-মজুরের সুলভ পারিশ্রমিকে নীল ও পাট চাষ করিয়ে ইংল্যান্ড ও অন্যত্র রফতানি করতে পারলে পর্যাপ্ত মুনাফা লাভের সম্ভাবনা, যা ভিন্ন কোনো সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে সহজে করা সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর মূলধন তাই বাণিজ্য-ফসলে বিনিয়োগ করা হয়। বিশেষ করে নীলচাষে। কোম্পানির শাসকরা চাষিদের দিয়ে নীল চাষ করাতেন। তারপর পুরোটাই এ দেশের কৃষকের বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাস। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির মালিক হয় জমিদার। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যবস্থার ফলে জমিদার শ্রেণিই লাভবান হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক শ্রেণি। কৃষকদের স্বার্থের কথা মোটেই চিন্তা করা হয়নি। দফায় দফায় রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। জনগণের পক্ষে এত বেশি করের বোঝা বহন করা সম্ভব ছিল কি না তা নিয়ে ইংরেজদের এতটুকু মাথাব্যথা ছিল না। সরকার, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার কৃষকের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ঋণ শোধ করতে অক্ষম হওয়ায় অনেকে জমিজমা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক ভাগচাষিও দিনমজুরে পরিণত হয়। উৎপাদনব্যবস্থা এবং পদ্ধতিতেও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব হয় তার নিত্যসঙ্গী। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ নয়, জমিদারদের প্রজা উচ্ছেদের নিরঙ্কুশ অধিকার বন্ধ হয়েছিল বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহের ফলে। মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’ ও অভয়চরণ দাশের ‘ইন্ডিয়ান রায়ত’ বইয়ে পাবনার কৃষক বিদ্রোহ বিশেষ স্থান পেয়েছে। সমুদ্রের বক্ষে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো একটি ঢেউ ভেঙে যেমন আরেকটি ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি ব্রিটিশ কর্তৃক এদেশের আগমনের পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে একটি দেশের স্বাধীনতা হরণ, আবার তা উদ্ধার করতে ত্যাগ ‘হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া কোনো’ বিপ্লব ছিল না। বিপ্লবের একটির সফলতার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে। বিপ্লবের শেষ বলে কোনো কথা নেই, দেশ বলেও কোনো কথা নেই। বিপ্লবের সাফল্যও স্থায়ী নয়। তার কার্যকারিতাও অনন্ত। ইংরেজ শাসক সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কাহিনি, নীলকর, বর্গি ও ঠগি দমনের নামে বিভিন্ন অত্যাচারের কাহিনি, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কাহিনি, কাবুলিওয়ালাদের কবর পিটিয়ে টাকা আদায়ের কাহিনি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-যুদ্ধসৃষ্ট ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষের কাহিনি আজও ভোলার নয়।