আধুনিক বাঙালির কাব্যসাধনার বিশেষ-একটা দিক ক্রমশই স্পষ্ট হ'য়ে উঠছে। কয়েকজন সজীব ও সক্রিয় কবি আছেন, যাঁদের ঝোঁক বলশালী উচ্চারণের দিকে, কঠিন উজ্জ্বলতার দিকে, মিতব্যয়ী শব্দ প্রয়োগের দিকে। এঁদের ছন্দও তাই কানে- কানে-টানা ধনুকের ছিলার মতো টান, কোনোখানে একটু ঢিলে হবার জো নেই। মাথা খাটিয়ে এঁরা কবিতা লেখেন এবং সেই শ্রম ধরা পড়লে লজ্জিত হন না। কবিতাকে জটিল ও দুর্গম, তথ্যবহ ও শাস্ত্রজ্ঞানসাপেক্ষ এবং সর্বোপরি নানা অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দে ও পরিভাষায় আকীর্ণ করতে এঁরা কুণ্ঠিত নন; রচনাবিন্যাসে অন্যমনস্কতারই কোনো প্রশ্রয় নেই এঁদের কাছে। এই শ্রেণির কবির মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে উল্লেখযোগ্য। এই দুই কবিতে সাদৃশ্য যতখানি, বৈসাদৃশ্য যদিও তার চেয়ে কম নয়; তবু মোটের উপর এঁদের সমগোত্রীয় ব'লে মনে করলে ভুল হয় না। এঁদের কোনো-কোনো কবিতা আমি ভালো বুঝতে পারি না। শক্ত হ'য়ে চেয়ারে ব'সে নানা পুঁথিপত্র ও অভিধান ঘাঁটলে তবে হয়তো এই জাতের কবিতা সম্পূর্ণ বোঝা যায়, কিন্তু সেই ধরনের 'বোঝা'র উপরই আমার খুব বেশি আস্থা নেই, এমনকি কবিতার রসগ্রহণে সেটাকে অপরিহার্য ব'লে আমি মনে করি না। সত্যি বলতে, কবিতা 'বোঝা'টাই যে সমস্ত কথা, এমনকি মস্ত কথা, তা আমি মানতে ইচ্ছুক নই। কোনো কবিতায় হয়তো ছন্দের দোলাটাই শুধু উপভোগ করি, কোনো কবিতা বিশেষ-একটা উপমা কি রূপক-ব্যঞ্জনার জন্যই মূল্যবান মনে হয়। কোনো কবিতার দুটো লাইন হঠাৎ মনের মধ্যে এমনভাবে গাঁথা হ'য়ে যায় যে পথে চলতে-চলতে হঠাৎ নিজেকে তা গুনগুন করতে শুনি। তখনই বুঝতে পারি সে-কবিতায় কিছু সারবস্তু আছে।সুধীন্দ্রনাথের কবিতাও আমার উপভোগের মধ্যে কোথায় যেন একটা ব্যবধান দেখতে পেয়েছি। তাঁর কবিত্বশক্তিকে স্বীকার ও সম্মান না-করা অসম্ভব; কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার মেজাজের মিল নেই। তবু এ-কথা স্বীকার করবো যে যখনই কলাকৌশলের অভিনবত্বে ও ছন্দের কৃতিত্বে আমি বিস্মিত হয়েছিলুম, 'ক্রন্দসী'তে আরো খানিকটা পরিণতি পাওয়া গেলো।