বিষ্ণু দে-র কবিতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের আগেই এ কথা আমাদের নানা সূত্রে শুনতে হয়েছে যে, তাঁর কবিতা কিঞ্চিৎ দুরূহ। রবীন্দ্রনাথ নাকি এই কবির কোনো একটি কবিতা বুঝিয়ে দিতে পারলে শিরোপা দেবেন-এমন আশ্বাস ও প্রলোভন দেখিয়েছিলেন আরেকজন কবিকে। এমন সব ঘটনা আর জনশ্রুতিকে উত্তীর্ণ হয়ে আমরা যখন বিষ্ণু দে-র কবিতায় এসে পৌঁছাই তখন স্বীকার করতে বাধ্য হই যে, কথাটা সর্বৈব মিথ্যা, এমন বলা যাবে না। আমাদের কাউকে কাউকে এই বিষয়টিও একটু বিচলিত করে যে, যিনি "মার্কসীয় চিদম্বরে” বিহার করেন, যে- কবি ভারতবর্ষ ও বাংলার বঞ্চিত ও সংগ্রামী মানুষের কথা এমন গভীর মমতা ও উদ্দীপনের সঙ্গে উচ্চারণ করেন, কিশেষত 'উর্বশী ও আর্টেমিস' আর 'চোরাবালি' পার হয়ে 'পূর্বলেখ'-এ পৌঁছে, এবং তারপর প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সেই কবি কেন এমন ভাষা এমন শৈলী গড়ে তুলবেন যা তাঁর বিষয় ও দর্শন থেকে দূরবর্তী, যা তাঁর কবিতাকে করে তুলবে কেবল শিক্ষিত বা দীক্ষিতের উপভোগ্য? এর মধ্যে কি স্ববিরোধ নেই, নেই উপায় আর উদ্দেশ্যের অসংগতি? তাঁর কবিতায়, অন্তত তাঁর প্রথম দিকের বহু কবিতায়, আছে অগণিত অভিধানের শব্দপুঞ্জ, আছে এতদঞ্চলে অপরিচিত বিদেশী পুরাণের দেবদেবী বা সংস্কৃতি-নায়কের উল্লেখ, আছে পাশ্চাত্যের সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলার এক বিশাল জগতের নানা অনুষঙ্গের চকিত ব্যবহার, আছে বেদ-উপনিষদ-ভারতীয় পুরাণ-মহাকাব্য মধ্যযুগের বাংলা কাব্য- রূপকথা-বাউলগান থেকে আরম্ভ করে রুশ ইতিহাস বা রবীন্দ্রনাথের নানা সূত্রের অব্যাখ্যাত উদ্ধার, আছে ফরাসি জর্মন সংস্কৃত ইংরেজি উৎকলন, আছে 'নির্চেরাগ', 'রুদন্ত'-র মতো অভিনব নির্মিতি, আছে "চংক্রমণের তুরঙ্গ পাকে উত্তরঙ্গ পাতি"-র মতো অনুৎসাহব্যঞ্জক বাক্য, আছে পঙ্ক্তি ভেঙে অন্য পঙ্ক্তিতে লাফানো প্রবহমাণতা বা আঁজামাঁ-র (enjambement) কারণে বাগুঙ্গি- বিপর্যয়, আছে ইঙ্গিতের অভাবিত সংক্ষেপ, আছে শব্দবন্ধের ভাঙাচোরা অন্বয়- দুর্বোধ্যতার লক্ষণ কী নেই সেখানে? এ সবের কারণে, কবিতায় মানুষের কথা বলা আর মানুষের পড়বার জন্য কবিতা লেখা- বিষ্ণু দে-র মধ্যে এ দুয়ের অসংগতিতে আমরা যখন বিব্রত বোধ করি, তখন এই অসংগতির হেতু সন্ধানের একটা দায়িত্বও এসে পড়ে আমাদের উপর। কেন তিনি দুর্বোধ্য হলেন? কেন নির্বাচন করলেন কবিতার এমন এক ভাষা, যা বিরূপ কিংবদন্তির সহায়তায় তাঁকে দূরে
বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। বিষ্ণু দের পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এছাড়াও অনুবাদের কাজ করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছে এলিয়ট, পল অ্যালুয়ার ও মাও-ৎ-সেতুঙের কবিতা। বিষ্ণু দে'র সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন, যেমন আর্ট অফ যামিনী রয়(সহযোগে) দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮) এবং ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার, এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পান।