অপেক্ষা জিনিসটা অনেকটা হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া মুতসুদ্দির মতো। এর যেন চাহিদাটাই আলাদারকম। চৌমাথা মোড়। এখানেই তো দাঁড়াবার কথা হয়েছিল শেষবার। ঘড়িটা আরও একবার মিলিয়ে নিলাম। মিনিটের কাঁটা সাড়ে ছ' টা ছুঁইছুঁই। পেট্রোলপাম্প ঘেঁষে রাস্তার আলোগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করছে। বাসে যাত্রীদের ভিড় বেড়ে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে উঠছে। উলটোদিকের চাইনিজ রেস্তোরাঁর গায়ে একটা পুরোনো বইয়ের হকার বসত কয়েক বছর আগেও। ওদিকটা অনেকদিন আসা হয়নি আমার। কিন্তু-কিন্তু করেও শেষমেশ ঠিক করলাম ওইদিকেই যাওয়া যাক। পুরোনোত্বের প্রতি আজ যেন একটা নেশা চেপেছে আমার। একে নস্টালজিয়া বলা যাবে কিনা, সেটা অবশ্য জানা নেই । কথা ছিল পেট্রোল পাম্প লাগোয়া ফার্নিচারের দোকানটার সামনে দাঁড়াব। দেখা করার সময় সময় সাড়ে পাঁচটা। একঘণ্টা একটু কথাবার্তা আর আড্ডা মেরে তারপর সাড়ে ছ'টায় শো। অন্তত ফোনে এমনটাই কথা হয়েছিল। কিন্তু এখন ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে পুরো প্ল্যানটাই বানচাল হবে। আমি? আমি অর্কপ্রভ। অর্কপ্রভ সান্যাল। পেশাগতভাবে কলকাতা মেডিকেল কলেজের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ। আজ অবশ্য আমার এই নাছোড় অপেক্ষা কোনো পেশাগত বা প্রণয়ঘটিত কারণে নয়। বরং দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর একটা বেঁটেখাটো রিইউনিয়ন-লিঙ্গু নস্টালজিয়াই এর কারণ। আর এই বিফল অপেক্ষাও নতুন তো নয় ৷ নস্টালজিয়ার মধ্যে একটা অবসেশন লুকিয়ে থাকে। ঠিক প্রথম প্রেমের মতোই । অনেক চেষ্টা করেও তাকে অস্বীকার করা যায় না। আজ যেমন বারবার ঘুরেফিরে আমার সেই দিনটার কথাই মনে আসছে। ইন্টারকলেজ ফেস্ট। ইতিমধ্যেই কলেজের হলঘর বিভিন্ন কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। একটা চাপচাপ উত্তেজনা। তখনকার জি এস পবিত্রদা ভরাট গলায় মঞ্চে উঠে ঘোষণা করে দিল, ‘আমাদের পরবর্তী নিবেদন মেঘনাদবধ কাব্য'। ফেস্ট ব্যাপারটা কলেজ লাইফে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করবার চ্যালেঞ্জ। অথচ বিশ্বচরাচরে নতুনত্বের অবশেষ কতটুকুই বা? কিন্তু সে কথা তখনকার আমাকে আর কেই বা বোঝাবে! আর এ তো মেঘনাদবধের একক। ততক্ষণে আমাদের প্রিন্সিপাল চলে এসেছেন।