"আদর্শ হিন্দু-হোটেল' উপন্যাস বিকৃতিভূষণের এক অসাধারণ সৃষ্টি। বিভূতিভূষণ আপন ভোলা মানুষ হলেও অলস অকর্মণ্য ছিলেন না। তিনি অলস অকর্মণ্য উদ্যমহীন মানুষ পছন্দও করতেন না। তিনি মনে করতেন মানুষ নিজস্ব উদ্যম, উদ্যোগ আর কর্মের দ্বারা নিজেকে উন্নত জীবনের অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তাঁর প্রায় সব উপন্যাসেই আমরা দারিদ্র্যের দুঃসহ-দুর্দশার চিত্র পাই। আবার সেই দারিদ্র্য থেকে সংগ্রাম করে জীবনে সমৃদ্ধি অর্জনের চিত্রও তাঁর উপন্যাসে তিনি এঁকেছেন। "বিপিনের সংসার সহ অনেক উপন্যাসেই আমরা এটা দেখে থাকি। দারিদ্র্যকে জয় করে সুখময় জীবন প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাই বিভূতিভূষণের প্রধান প্রতিপাদ্য। আর মানুষ ইচ্ছে করলেই তা পারে। কর্মের দ্বারা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করাই প্রকৃত কর্মবীরের কাজ। 'আদর্শ হিন্দু-হোটেল' উপন্যাসের হাজারি ঠাকুর বিনয়ী হলেও যথার্থই কর্মবীর। জীবনকে সে কর্ম দিয়েই জয় করেছে। শ্রম ও অধ্যবসায় থাকলে কোনো কিছুই মানুষকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। অপ্রতিরোধ্য জীবন-শক্তিই 'আদর্শ হিন্দু-হোটেল' উপন্যাসের মূল কথা। উপন্যাসটি সম্পর্কে লেখক বলেছেন 'এই উপন্যাসটি সম্বন্ধে লোকে ভুল বোঝে। আমি 'আদর্শ হিন্দু-হোটেল' উপন্যাসে দেখাইতে চাহিয়াছি মানুষ যদি কর্তব্যনিষ্ঠ এবং শ্রমবিমুখ না হয় তবে শত বাধা-বিঘ্নের পরেও জীবনে সাফল্য আসে। কোনো বাধা-বিঘ্নই গতিরোধ করিতে পারে না।'
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।