আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। তিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। কারণ তাঁর কবিতা তৎকালীন বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জোগায়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্থ বাস্তবতা, সা¤প্রদায়িকতার হিংস্রতা দেখে তিনি আঘাত পান। এ সকল অসঙ্গতিই তাঁকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা জোগায়। চল্লিশের দশকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে গনজাগরণ মূলক কবিতা লেখে জনপ্রিয়তা পান কবি ফররুখ আহমদ। মানবতাবাদ, জাগরণ, ঐতিহ্য আর জাতিসত্তার কবি ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে মহান উচ্চতায় অধিষ্টিত। জাতীর আগামী স্বপ্নের জাল বুনতে পথ দেখিয়েছেন এই মহান কবি। তাঁর সৃষ্টিমসূহ বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে। মুসলিম ঐতিহ্যের পুনর্জ্জীবন কামনা করে রোমান্টিকতার আবহে কবি জাতিকে জেগে ওঠার আহবান করেছেন। অন্যরা যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যে এগিয়ে যাচ্ছে কবি তখন পিছিয়ে পড়া তাঁর নিজ জাতিকে জেগে ওঠার আহবান জানান। ফররুখ আহমদের প্রয়োজনীয়তা বাঙালির ইতিহাসের জন্যই। তাঁর অস্তিত্ব বাংলা সাহিত্যের সৌন্দর্য বাড়ায়। ফররুখ আহমদের সৃষ্টিসম্ভার বাংলা সাহিত্যকে আরো বৈচিত্যময় ও সমৃদ্ধ করে তোলে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর রচনা বহুমাত্রিকতায় সুবিন্যস্ত। তিনি একাধারে কবিতা, অনুবাদ কবিতা, কাব্য নাটক, ছড়া, শিশু-কিশোর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি বিপুল সংখ্যক গান রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলীর বৃহদাংশ এখনো অগ্রন্থিত। আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত বাংলা একাডেমি থেকে ২ খÐ রচনাবলী প্রকাশের পর অজ্ঞাত কারণে বাকি খÐগুলো আর আলোর মুখ দেখেনি। এ কারণেই তাঁর সকল রচনা পাটকের সামনে আসেনি। এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। ফররুক আহমদ জীবন দশায় তাঁর রচনাসমূহকে পরিকল্পিতভাবে সুবিন্যস্ত করে যাওয়ার সুযোগ পাননি। মৃত্যুর এত বছর পরও এর কোন সদ-উদ্যোগ এখনো কেউ গ্রহণ করেনি। আর এই কারণেই সাধারণ পাঠকমহল শ্রেষ্ঠ সম্পদ আস্বাদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই অনুভব থেকেই ‘শ্রেষ্ঠ ফররুখ’ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ফররুখ আহমদের এমন সব রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা সম্পাদকের বিবেচনায় তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের সবচেয়ে অনিন্দ্য ফসল। ‘শ্রেষ্ঠ ফররুখ’ গ্রন্থটি বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ প্রকাশ করতে পেরে আনন্দিত। কবি পরিবার উক্ত গ্রন্থপ্রকাশে সানন্দ সম্মতি দিয়েছেন। সম্পাদনা করার ক্ষেত্রে কবি, সাহিত্য সম্পাদক ও সাহিত্য গবেষক জাকির আবু জাফর গুরু দায়িত্ব বহন করেছেন। আশা করি ‘শ্রেষ্ঠ ফররুখ’ গ্রন্থটি পাঠক মহলে এবং স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ফররুখ আহমদের জন্ম -জুন ১০, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে (তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তার বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখ আহমদের মায়ের নাম রওশন আখতার। ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি 'মুসলিম রেনেসাঁর কবি' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। ১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক "প্রাইড অব পারফরমেন্স" এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাঁকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। তিনি অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪ সালে মৃত্যু বরণ করেন।