ভূমিকা লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৬৫)-এর জন্ম হয়। আসল নাম সুবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত তার লেখনীতে বিশাল বিস্তীর্ণ নদ-নদীর পটভূমিকায় সাধারণ মানুষের কথা যেমন বস্তুনিষ্ঠা জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমনি মানুষের কর্মে পিপাসায় জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আদিমতার অন্ধকারে ফিরে গেছেন বার বার। অদ্ভুত নিরাসক্তভাবে তিনি মানুষের জীবন ও সমস্যাকে দেখেছেন, সমাধানের চেষ্টাও করেছেন বুদ্ধি ও লেখনীতে। নর-নারীর জৈবসত্ত্বা বিকাশের নানাদিক তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার লেখায় জৈবসত্ত্বা ও দৈহিক বর্ণনায় ছিলেন কিছুটা বেপরোয়া প্রকৃতির। দৈহিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে যথেষ্ঠ বলিষ্ঠ ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বলিষ্ঠতা রক্তের উষ্ণ-স্রোত উত্তাপ টের পাওয়া যায় তার গল্প- উপন্যাসের চরিত্রের বর্ণনায়, পেশায়, কাজে-কর্মে। মানিকের সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশটা একটা চমক এবং চমক 'অতসী মামী' রচনার ইতিহাস, চমক 'দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), 'জননী' (১৯৩৫), 'পদ্মানদীর মাঝি' (১৯৩৬), 'পুতুলনাচের ইতিকথা' (১৯৩৬), 'অহিংসা' (১৯৪৮) ও 'চতুষ্কোণ' (১৯৪৩) প্রভৃতি। পাঠকের চেতনাকে নাড়া দিতে পেরেছেন বলেই এগুলো পাঠকের কাছে আদরণীয় 'অতসী মামী' গল্পের মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা। পরবর্তীতে তিনি 'প্রাগৈতিহাসিক' 'সরীসৃপ' 'হারাধনের নাতজামাই' 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' 'ফেরিওয়ালা' 'বৌ' 'সমুদ্রের স্বাদ'-এর মতো জীবন-সমৃদ্ধ শিল্পসার্থক গল্প লিখলেন। তাঁর এই সফলতা ও সার্থকতার কারণ রয়েছে। তাঁর অভিজ্ঞতার পসরা ছিলো বিচিত্র ও বিস্তীর্ণ। মধ্যবিত্ত অভিযাত্রিক সচেতনতার মধ্যে জন্ম বর্জিত হলেও বিত্তের অস্বচ্ছলতার চাপ শিল্পীকে ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করতেই হয়েছে প্রায় আগাগোড়া। এককথায় মানবিক বিশ্বাসের মূলে চিড় ধরেছিল। আসলে মানিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মানব সত্যের প্রাণ ও স্বপ্নপুরুষ ।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।