"শরৎ রচনাসমগ্র -১ম খণ্ড"বইটির ভূমিকা: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৭) জন্ম হয়েছিল তাদের পৈতৃক নিবাসে, দেবানন্দপুর গ্রামে। গ্রামটি ব্যান্ডেলের অদূরে সরস্বতী নদীর ধারে অবস্থিত। পৈতৃক এই গ্রামে শরৎচন্দ্রের শৈশবকাল কেটেছিল । পাঠশালায় পড়া ও সেখান থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু। পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, মাতা ভুবনমােহিনী। শরৎচন্দ্রের মাতুলালয় ছিল হালিসহরে। তার মাতামহ ভাগলপুরের কাছারিতে কেরানীর কাজ করতেন। তিনি সেইখানেই উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন। কলকাতা থেকে বর্মা যাবার কালে তিনি তাঁর একটি গল্প মন্দির’ কুন্তলীন পুরস্কারের জন্য দাখিল করে যান। স্বাভাবিক সঙ্কোচবশতই তিনি গল্পটি নিজের নামে না পাঠিয়ে মাতুল-সম্পর্কীয় অনুজকল্প ভক্ত সাহিত্যানুরাগী সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির নামে পাঠিয়েছিলেন। গল্পটি প্রথম পুরস্কার পায় এবং ‘কুন্তলীন পুরস্কার পুস্তিকামালায় প্রকাশিত হয় (১৩১০)। গল্পটির গৌরব দেখে শরৎচন্দ্র গল্প লেখায় নতুন করে উৎসাহ বােধ করেন। বর্মাতে তিনি সাহিত্যসাধনা সুযােগমত চালিয়ে যেতে থাকেন। এখান থেকে নতুন লেখা (?) একটি বড়ােগল্প ‘ভারতী’-তে প্রকাশের জন্যে পাঠিয়ে দেন। তখনকার দিনে সাহিত্যপত্র হিসাবে সবচেয়ে কদর ছিল ভারতী’র। তখন ‘ভারতী’ পত্রিকা চালাতেন স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলা দেবী। বড়দিদি গল্পটি ভারতী’-তে তিন কিস্তিতে প্রকাশিত হল (১৩১৪)। শরৎচন্দ্র সাহিত্যকর্মে আরও উৎসাহিত হলেন। গল্প রচনায় তাঁর মনে নতুন জোয়ার এল। তিনি বর্মায় বসে অনেক গল্প লিখলেন। যদিও এসব গল্পের বস্তু তার মনে সঞ্চিত ছিল ভাগলপুরের সময় থেকেই। তবুও তখন এসব গল্প লেখার মত মনের স্থিরতা ও অনুভবের গাঢ়তা তাঁর আসেনি এবং আসবার কথাও নয়। এখন সে মানসিক স্থিরতা ও হৃদয়াবেগের ধীরতা পেয়েছেন বলেই ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’র মত গল্প লেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল । (১৩২২-১৩৩৯) ভারতবর্ষে প্রথমে শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী’ নামে ও পরে ‘শ্রীকান্ত' নামে শেষ পর্ব বেরিয়েছিল বিচিত্রা' পত্রিকায়। তিনি সে সময় ‘পথের দাবী’ নামক একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এ উপন্যাসটি খুব সমাদৃত হওয়ার পর গভর্ণমেন্ট বইটির প্রচার নিষিদ্ধ করায় বইটির সমাদর আরাে বৃদ্ধি পেয়েছিল। শরৎ রচনাবলির প্রথম খণ্ডে মূলত: শ্রীকান্ত এবং গল্পগুলাে সংকলিত হয়েছে।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।