"শরৎ রচসাসমগ্র -২য় খণ্ড"বইটির ভূমিকা: বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) প্রাতিস্বিকতায় উজ্জ্বল এক যুগপুরুষ। তিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী হিসেবে সমধিক পরিচিত। গল্প বলার নৈপুণ্য, নারীমহিমা-কীর্তন, ভাবালুতাসৃষ্টির দৃঢ়তা ও একান্তভাবে হৃদয়াবেদন শরৎচন্দ্রকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দিয়েছে। ঘরােয়া পরিবেশ ও আটপৌড়ে ভাষা বাঙালি পাঠককে অন্ধ শরম্ভক্ত করে তুলেছে। উপন্যাস সাহিত্যে শরৎচন্দ্র আমাদের অনেক কাছের মানুষ, আপনজন। শরৎ-উপন্যাস পল্লীর জীবনভাষ্য। নগরসভ্যতার সর্বাঙ্গীন আশীর্বাদপুষ্ট নগরজীবন। থেকেই সাহিত্যের উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন উনিশ শতকের সাহিত্যিকরা। ঐ সময়কার গদ্য রচনায় ও প্রবন্ধ পুস্তকে বাংলার দুর্ভাগা চাষীদের দারিদ্র্য-সমস্যা ও বৃত্তি সংকট নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযােগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু সৃজন শিল্পের এ বিষয়ে কার্পণ্য বেশ চোখে পড়ার মতাে। দু-একটি নাটক প্রহসনে পল্লীজীবন এসেছে প্রসঙ্গের প্রেরণাবশেই। উপন্যাস শিল্পে গ্রাম্য জীবন প্রবর্তন ঘটেছে আরাে বিলম্বে, একেবারে পরের শতাব্দীতে। প্যারীচাদ শহরতলিকে আখ্যানসূত্রে (আলালের ঘরের দুলাল) জড়াতে চেয়েছিলেন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিক অভিলাষ থেকে। শরৎচন্দ্রই প্রথম সাহিত্যিক যিনি ব্যাপক ভিত্তিতে গ্রামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের পল্লীপ্রত্যয়ের কিছু অপূর্ণতার প্রসঙ্গ বলে রাখা প্রয়ােজন। পল্লীর সমস্যা সমাধানের প্রথম কথা ভূমিসংস্কার। শরৎ উপন্যাসের পল্লী চরিত্রের এই ভূমিজ বন্ধন তেমন স্পষ্ট নয়। জমিদার ও কৃষকের আবহমানকালব্যাপী মূল লড়াইয়ের ছবি তাঁর রচনায় স্পষ্ট হতে পারেনি। অন্যদিকে পল্লীর মানুষের জীবন বাস্তবতার মূল ভিত্তি হলাে তার বৃত্তি সম্পৃক্ততা। শরৎ উপন্যাসে বৃত্তিখাত জীবন-যাপনের ছবি আদৌ সুপরিস্ফুট নয়। ‘মহেশ' ছােটগল্পে বাস্তবানুসন্ধানের যে ঝিলিকটি দেখা দিয়েছিল, শরৎ উপন্যাসে সেই প্রেরণা জাগ্রত থাকলে চিত্রগুলাে অন্যপ্রকার হতে পারতাে। ঐ গল্পের শেষে শােষকশ্রেণির প্রতি যে ক্রোধ-ঘৃণা-অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে, তার বদলে নিরপেক্ষ বিষন্নতা ও সহজ সহানুভূতি নিশ্চয় স্থান করে নিতে না উপন্যাসে। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমাজ বিন্যাসের গভীর স্তরে যেতে না চাইলেও পল্লী শােষণের রূপ সম্বন্ধে মােটেই অন্ধ নন শরৎচন্দ্র। শরৎ উপন্যাসে এই উৎপীড়ন ব্যক্তি ভূ-স্বামীর ক্ষমতার মদমত্ততার পরিচায়ক নয়, বরং গােষ্ঠী ষড়যন্ত্রের মুখােশটি ছিড়ে দেয়। জমিদার বা ধনী ভূ-স্বামীর সঙ্গে স্বার্থান্ধ ব্রাহ্মণ শ্রেণির আঁতাতের রূপটি তাঁর রচনায় খুবই স্পষ্ট। ব্রাহ্মণ-পূর্ব প্রতিপত্তির জায়গা থেকে ইতিহাসের বিচারেরই স্খলিত হয়ে এসেছে। অথচ তেজোহীন ব্রাহ্মণের হাতেই আজও ধর্মীয় রায়দানের অধিকার ন্যস্ত। ক্ষমতার লালসর কারণে হতশ্রী ব্রাহ্মণ্য সমাজ, সমাজ প্রশাসকের সঙ্গে স্বার্থ বৃষ্ট সম্পর্কে যুক্ত। আর সন্তে ছড়ি যার হাতে, ধর্মীয় প্রতিভূর রায় তার পক্ষে গেলে শশাষণ উৎপীড়ন
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।