"গল্পগুচ্ছ (অখণ্ড সংকলন)" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ভাব থেকেই তার বেশিরভাগ গল্পগুলি অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। এককথায় এটাই বলা যায় যে, যে-মনােধর্ম, মনের যে বিশেষ দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের সৃজনীপ্রতিভাকে গতিধর্মী করেছে সেই মনােধর্ম, সেই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে গােড়ার দিকে তাঁর ছােটগল্পের উৎসেরও সন্ধান দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ছােটগল্পগুলাের রচনা যে সময়টাতে আরম্ভ হয়, এবং জীবনের যে পর্বটিতে অধিকাংশ গল্পগুলাে রচিত হয়, সেই উদ্ভব ও বিকাশের সময়ের প্রতি একটু লক্ষ্য রাখলে, তাঁর ছােটগল্পের উৎসটিকে, ধর্মটিকে, আরাে ভালােভাবে বােঝা সম্ভব। তার বেশিরভাগ গল্প রচিত হয়েছিল বাংলা, ১২৯৮ থেকে আরম্ভ করে ১৩১০ সালের মধ্যে। অবশ্য তার পরেও আরও কয়েকটি সুপ্রসিদ্ধ গল্প ১৩১৪ থেকে আরম্ভ করে ১৩২৫ সালের মধ্যে লেখা হয়েছিল। কিন্তু তার অধিকাংশ গল্পের মূলধর্মটি ১২৯৮-১৩১০ সালের রচনাগুলাের মধ্যেই বেশিমাত্রায় প্রবল। ‘সােনার তরী’ থেকে আরম্ভ করে ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’, কাহিনী কল্পনা, কথা, ‘ক্ষণিকা’র কবিজীবন একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বিশেষ করে সােনার তরী', ‘চিত্রা’ এবং “চৈতালি’র কবিতায় সমস্ত বিশ্বজীবনের সঙ্গে কী সুসহজ ও আনন্দপূর্ণ তাঁর যােগ; সকল কাজ, সকল অভিজ্ঞতার মধ্যে তাঁর অপূর্ব বিস্ময়কর সৌন্দর্যবােধ। তুচ্ছতম জিনিসটিও তাঁর দৃষ্টি আড়ালে থাকে নি; জলে যে হাঁস ভেসে বেড়ায়, নদীর চরে যে লােকটি বসে বাঁখারী চাঁছে, গ্রামের যে মেয়েটি ঘাটে বসে অঙ্গের বসন ফেলে দিয়ে গা ঘষে, সবই তাঁর চোখে পড়েছে, সবকিছুর মধ্যেই তিনি অপরিসীম প্রেম ও সৌন্দর্যের বিকাশ দেখতে পেয়েছেন, সকল জিনিস মিলিয়ে তাঁর প্রাণে এক অপূর্ব মায়ালােক সৃজন করেছে। সৃষ্টির প্রতি তাঁর একটি অপূর্ব ভালবাসা, একান্ত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস এই সময়ের কবিজীবনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে। মনের যখন এই অবস্থা, জীবনের অতি তুচ্ছ খুঁটিনাটি জিনিসও যখন তাঁর কাছে অপূর্ব বলে মনে হয়েছে, নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ হয়ে যখন তিনি প্রকৃতির অতি তুচ্ছ সামান্য ব্যাপারটিকেও অত্যন্ত রহস্যময় বলে মনে করে আকুল আগ্রহে তা উপভােগ করছেন, তখন, ভাবকল্পনার ঠিক এই পরম মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর ছােটগল্প রচনার সূত্রপাত হল এবং দেখতে দেখতে সেই অবস্থার মধ্যেই তার অধিকাংশ গল্পগুলাে রচিত ও প্রকাশিত হল। প্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবােধ, জীবনের অতি তুচ্ছ ব্যাপারকেও পরম রমণীয় ও অপূর্ব রহস্যময় বলে অনুভব করা, তাদের প্রতি অপূর্ব শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, আপনাকে একান্তভাবে নির্লিপ্ত করে দিয়ে একমনে জীবনটিকে প্রকৃতির সকল অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে উপভােগ করা-এসমস্তই তাঁর ছােটগল্পগুলির মধ্যেও অপূর্ব রসে অভিষিক্ত হয়ে উঠেছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের কাব্যসৃষ্টি থেকেই নয়, কবির এই সময়কার জীবনযাত্রার প্রতি লক্ষ্য করলেও তাঁর ছােটগল্প রচনার উদ্ভবের সময়টি আমরা বুঝিতে পারব এবং তাতে এই গল্পগুলাের বিশেষ ধর্মটি আরও সহজে আমাদের কাছে ধরা দেবে। তাঁর একটি সুপ্রসিদ্ধ গল্প পােস্টমাস্টার ১২৯৮ সালে লেখা। এর কিছুদিন আগে থেকেই কবি জমিদারি দেখাশুনার ভার নিয়েছেন, এবং তার দিনগুলাে কাটছে পদ্মার উপরে নৌকায় ভেসে ভেসে সাজাদপুরে, শিলাইদহে। অপূর্ব আনন্দময়, বৈচিত্র্যে ভরপুর এই সময়কার জীবনযাত্রা। বাংলাদেশের একটি নির্জন প্রান্ত, তার নদীতীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুর চর, অবারিত মাঠ, ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম, সহজ অনাড়ম্বর পল্লীজীবন, দুঃখপীড়িত অভাবে ক্লিষ্ট অথচ শান্ত সহিষ্ণু গ্রামবাসী, সবকিছুকে কবির চোখের সামনে তুলে ধরেছে, আর কবি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পুলকে শ্রদ্ধায় ও বিশ্বাসে তার অপরিসীম সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করছেন। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পল্লীজীবনের সুখদুঃখের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হতে আরম্ভ করল; গ্রামের পথঘাট, ছেলেমেয়ে, যুবাবৃদ্ধ সকলকে তিনি একান্ত আপনজন বলে জানলে “ছিন্নপত্রে এই সময়কার প্রত্যেকটি চিঠিতে কবি নিজেই বারবার এসব কথা বলেছেন। পল্লীজীবনের এসব নানা বেদনা ও আনন্দ যখন তাঁর মনকে অধিকার করে বসল তখন তার ভাব ও কল্পনার মধ্যে আপনা-আপনি বিভিন্ন গল্প রূপ পেতে আরম্ভ করল, তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনা ও ব্যাপারকে নিয়ে এসব বিচিত্র সুখদুঃখ অন্তরের মধ্যে মুকুলিত হতে লাগল। মানবজীবনের বিচিত্র ঘটনা প্রকৃতির ভাষাময় আবেষ্টনের সঙ্গে এক হয়ে গেল। এরই প্রেরণা পেয়ে গল্প লেখার ইচ্ছা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠল; এক-একদিন এক-একটি ছােটখাট ঘটনার সূত্র ধরে এক-একটি গল্প মনের মধ্যে জমে উঠল। ১৮৯৪-এর ২৭ জুন শিলাইদহ থেকে একটি চিঠিতে তিনি লিখিছেন. আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছােট ছােট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি, এবং কৃতকার্য হতে পারলে পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লিখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে। আজ সকালবেলায় তাই গিরিবালা নাম্নী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছােট অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতারণ করা গেছে। এভাবেই এই দিনে তিনি ‘মেঘ ও রৌদ্রের মতাে একটি সুবিখ্যাত ছােটগল্পের সৃষ্টি করলেন। এভাবেই, দুই বছর আগে (২৯ জুন, ১৮৯২) সাজাদপুরের কুঠিতে একদিন গ্রামের পােস্টমাস্টারের আগমন উপলক্ষ করে ‘পােস্টমাস্টার’ গল্পটির সৃষ্টি হল। সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ী, 'ছুটি' গল্পের ফটিক এরাও এই সময়কার সৃষ্টি। ‘পপাস্টমাস্টার’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথের প্রথমতম গল্পগুলাের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের একশ্রেণীর গল্প একান্তভাবে গীতধর্মী, এই গল্পটি থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। একটি স্বজনহারা নিঃসহায় গ্রাম্যবালিকার স্নেহলােপ হৃদয় আসন্ন স্নেহবিচ্যুতির আশঙ্কায় কী সকরুণ অশ্রুসজল ছায়াপাত করেছে এই গল্পটির উপর! রবীন্দ্রনাথের এই গীতধর্মী গল্পগুলাের একটা প্রধান বিশেষত্ব এই যে কবির কল্পলােকের মানুষগুলাে, তার ঘটনার আবেষ্টনটি, বাইরের চতুর্দিকের জগতের সঙ্গে, প্রকৃতির ছায়া-আলাে-গন্ধ-বর্ণধ্বনি ও ছন্দের সঙ্গে একান্তভাবে মিশে যায়, এবং বিশ্বজগতের পারিপার্শ্বিক ভাষাময় আবেষ্টনের সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে একটি সুরের জগৎ সৃষ্টি করে, সকল ঘটনার একটি আকাশ সৃজন করে। এই ‘পােস্টমাস্টার’ গল্পটি এবং এরকম অনেক গল্পের মধ্যে এই বিশেষত্বটি চোখে না পড়েই পারে না। স্বজন থেকে দূরে, এক নিভৃত পল্লীতে দরিদ্র পােস্টমাস্টারের জীবন প্রথম প্রথম নির্বাসনতুল্য বলেই মনে হত। মাঝে মাঝে একাএকা ঘরে বসে বসে তিনি একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তির সঙ্গ কামনা করতেন, নিজের ঘরের ছেলে মেয়ে স্ত্রীর কথা তার মনে হত। এই কামনাটুকু গল্পটিতে কী সুন্দর একটি করুণ রূপ লাভ করেছে। এই গল্পটিতেই বিদায় যখন ঘনিয়ে এল, রতন পােস্টমাস্টারের সামনে থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। ভূতপূর্ব পােস্টমাস্টার ধীরে ধীরে নৌকার দিকে চললেন। - “যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল-বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মত চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন, একটি সামান্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি, কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরবেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে—এবং নদী প্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কি? পৃথিবীতে কে কাহার? গল্পগুচ্ছ অখণ্ড সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের সবগুলাে গল্পই সংকলিত হল। বিশ্বভারতী সংস্করণ-এর রচনাসজ্জাকে আমরা আবিকৃতভাবে উপস্থাপন করলাম। তাঁর কৃতিত্বের কথা শেষ করতে হলে তাঁরই উক্তি উপস্থাপন করা দরকার। যেমন“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল- ঝড় থামিয়া গেল, জল নামিয়া গেল- সুরবালা কোনাে কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল, আমিও কোনাে কথা না বলিয়া আমার ঘরে গেলাম।” রবীন্দ্রনাথের ছােটগল্প মানেই, সব কথা বলার পরও তিনি যেন কিছুই বলেননি।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।