ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের রচনাবলী দীর্ঘ দেড় শ’ বছর পর আবারো উন্মোচিত হচ্ছে বাংলাভাষী পাঠক ও বিদ্বান সমাজের সামনে। বাজারে ছিল তার ‘কোরআন শরীফ বঙ্গানুবাদ’, ‘আত্মজীবন’ ও ‘তাপসমালা’সহ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বই। এই ক’টি বাদে তাঁর রচিত ৪২টি বইয়ের প্রায় সবই চলে গিয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। গবেষকগণ তার হারিয়ে যাওয়া বইগুলোকে ‘দুষ্প্রাপ্য’, ‘দুর্লভ’ ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সম্প্রতি সেই ‘দুষ্প্রাপ্য’ অভিধার প্রায় সবগুলো বইয়ের আদি সংস্করণের সন্ধান লাভ সম্ভব হয়েছে। আর এ কাজটি নিবিড় অনুসন্ধানের মাধ্যমে করতে সক্ষম হয়েছেন তরুণ গবেষক শাফায়াত তৌসিফ। তার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত গিরিশ গ্রন্থাবলী একে একে প্রকাশ করে চলেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খোশরোজ কিতাব মহল লিমিটেড। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘মহাপুরুষ এব্রাহিমের জীবনচরিত’, ‘মহাপুরুষ মুসার জীবনচরিত’, ‘মহাপুরুষ দাউদের জীবনচরিত’, ‘হিতোপাখ্যানমালা’. ‘তাপসমালা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। খোশরোজ এবার নিয়ে এসেছে গিরিশচন্দ্র সেনের স্ত্রী ব্রহ্মময়ী দেবীর বিস্ময় জাগানো সংক্ষিপ্ত জীবনীগ্রন্থ—‘ব্রহ্মময়ী-চরিত’। ব্রহ্মময়ী দেবী বেঁচেছিলেন স্বল্পকাল। ছোট্ট জীবনে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী হবার কারণে সমাজের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গুরুগঞ্জনা, নিগ্রহ ভোগ করেছেন। তবু বিশ্বাসের অবিচলতা ত্যাগ করেননি। অন্তঃসত্বা অবস্থায় অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু মাস শেষ না হতেই প্রাণের কুঁড়ি ঝরে পড়ে মৃত্তিকার কোলে। ব্রহ্মময়ী দেবী বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের নৌকায় করে ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তাল পথ বেয়ে স্বদেশে (নরসিংদী) পৌঁছানো— সে এক ইতিহাস। নিদারুণ কষ্ট আর বেদনার পরশ মাখানো এক দুর্বিষহ সময়। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসাকে কিন্তু ভাই গিরিশচন্দ্র সেন হারাতে দেননি, ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ লিখেছেন তার এই জীবনচরিত। এক নিমেষে পড়ে ফেলার মতো এই বইটি বাংলাভাষায় জীবনীগ্রন্থের তালিকায় একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন, একথা নিসঃন্দেহে বলা যেতে পারে।
গিরিশচন্দ্র সেন-এর জন্ম হয় ১৮৩৪ সালের এপ্রিল অথবা মে মাসে। তখন ঢাকা জেলার অধীনে ছিল নারায়ণগঞ্জ। এটি ছিল মহকুমা। এর অধীন ছিল রূপগঞ্জ থানা। এই থানার একটি গ্রাম পাঁচদোনা। এ গ্রামের শ্রীমাধবরাম সেন ও জয়কালী দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে তাঁর শিক্ষা উল্লেখযােগ্য নয়। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। এই শিক্ষার গুণে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, পত্রিকা সম্পাদনা এবং কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রচারকের কাজ সবই কৃতিত্বের সঙ্গে করেছিলেন। তার মানসিক উৎকর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল কোরানের অনুবাদ ও ইসলামী শাস্ত্রচর্চা। তাঁর শুভবুদ্ধির জন্ম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে হয়নি, হয়েছে স্বশিক্ষা থেকে। ১৯১০ সালের ১৫ই আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।