সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ শাখা ছোটগল্প। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোর পরে ছোটগল্পের উদ্ভব হলেও পাঠকহৃদয় জয় করার ক্ষেত্রে ছোটগল্পের অবদান অভাবনীয়। নগরায়নের ফলে মানুষের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এক জায়গায় বেশ খানিকটা সময় দেওয়া মানুষের পক্ষে প্রায় ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে সাহিত্যের রসাস্বাদনের ক্ষেত্রে এসেছে নতুনত্ব। যেখানে পুরো একটি উপন্যাস পাঠের মতো রস এবং গল্প থাকবে আবার খুব সহজেই তা পাঠ করা যাবে। এর ফলে সাহিত্যিকদের কলমে উঠে আসে ছোটগল্প। গল্পের আবির্ভাব মূলত গুহাবাসী মানুষের মাধ্যমেই। একে অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করত ভাষার মাধ্যমে। আর মনের কথাগুলো একটু সাজিয়ে গুছিয়ে ধীরে ধীরে গল্পের আবির্ভাব হয়। যার প্রথম পর্যায়ে রূপকথার গল্প, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প, নীতিবোধ জাগ্রত করার মতো গল্প। এরই সুদূরপ্রসারী রূপ নিয়ে সার্থক গল্পের জন্ম হয়। এক কথায় ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্দেশ করা বেশ শক্ত। অনেকে অনেকভাবেই ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেছেন। ইংরেজি লেখক এইচ.জি. ওয়েলস বলেন, ছোটগল্প দশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। (কবীর চৌধুরী, সাহিত্য-কোষ, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ১১৮)। “ছোটগল্প হলো প্রতীতি-জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনি, যার একতম বক্তব্য, কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য-সংকটের মধ্যদিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।” (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যে ছোটগল্প বাংলা গল্প-বিচিত্রা, কবি প্রকাশনী, কাঁটাবন, ঢাকা ২০১৮, পৃষ্ঠা ২০৮)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সোনার তরী কাব্যের বর্ষাযাপন কবিতায় লিখেছেন,
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।