"শেষের কবিতা সে-সময়ে যেটা আমাদের মনে সবচেয়ে চমক লাগিয়েছিলো সেটা ‘শেষের কবিতা’র ভাষা। অমন গতিশীল, অমন দ্যুতিময় ভাষা বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে আমরা পড়িনি। এ-রকম ভাষা যে বাংলায় সম্ভব তাও আমাদের কল্পনার অগোচর ছিলো। ক্রিয়াপদের স্বল্পতার দরুন বাংলা গদ্যের অত্যন্ত ধীর মেজাজটা প্রথম থেকেই পীড়া দিচ্ছিলো আমাদের, সেটাকে বেশ দ্রুত তীক্ষ করে তোলাই ছিলো আমাদের লক্ষ্য। নানারকম পরীক্ষা হচ্ছিলো, হয়তো কিছু গতিও এসেছিলো, কিন্তু সেই খণ্ড-খণ্ড চেষ্টাকে ‘শেষের কবিতা’ বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। এর পাতায়-পাতায় ভাষার এত ঐশ্বর্য ছড়ানো, কোণেকোণে এত চমক নানা রঙে জ্বলে ওঠে যে আমাদের মতো যুবাবয়সী সাহিত্যব্যবসায়ীর পক্ষে আত্মহারা হয়ে কোনো উপায় ছিলো না। বাংলা গদ্য যে এত সাবলীল হতে পারে, তাকে যে ইচ্ছেমতো বাঁকানো, হেলানো, দোমড়ানো, মোচড়ানো সম্ভব, আলো-ছায়ার এত সূক্ষ্মস্তর তাতে ধরা পড়ে, খেলা করে ছন্দের এত বৈচিত্র্য, তা আমরা এর আগে ভাবতে পারিনি। তাই এই বইটি হাতে পেয়ে যদি আমাদের মনের অবস্থা চ্যাপম্যানের হোমারপাঠান্তে কীটসের মতো হয়ে থাকে, তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। বুদ্ধদেব বসু "
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।