ফ্ল্যাপে লিখা কথা ড. রহমান হাবিব-এর ‘বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন’ গ্রন্থটি বিশ শতকের শতবর্ষের বাংলাদেশের চিন্তা-দর্শনের সামগ্রিক প্রয়াস-তাৎপর্য চিহ্নিত একটি গ্রন্থ। শতবর্ষ পরিসরের প্রথম অর্ধশত বছরের বাঙালির চিন্তন ও মননের পটভূমি আমাদের সামাজিক-ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক মৌলস্ববাবের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সংস্কারমুক্তির আলোকিত ভিত্তিমূলে কীভাবে ক্রমাগ্রগামী হয়েছে, তার প্রেক্ষাপট ও বুদ্ধিবৃত্তিক অর্ন্তদর্শনসহ শতাব্দীর শেষ অর্ধাংশের মনন ও মনীষার বৈশ্বিক অনুভাবনার সমুপস্থিতি কেমন করে বাঙালির মননবৃত্তিকে প্রাজ্ঞতামুখী দূরগামী করেছে-তারই মাননিক ইতিবৃত্ত গ্রন্থটিতে বিশ্লেষিত ও মূল্যায়িত হয়েছে।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্বের ৪৭ বছর, পাকিস্তান-উপনিবেশের ২৪ বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশ-পর্বের ২৯ বছরের অর্থ্যাৎ শতবর্ষের সামাজিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাঙালির অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ফোকলোর,প্রত্নতত্ত্ব, সংবাদ-ভাষ্য, ধর্ম, নৈতিকতা, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য, দর্শন, প্রশাসন, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বায়নের বোধগত প্রেক্ষণবিন্দু শৃঙ্খলিত করে চলেছে; আত্নঐতিহ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাতিস্বিকতাময় স্বদেশিকতার স্পর্ধাই যে উন্নয়নশীল দেশের প্রকৃত উন্নতিকে সম্ভাবিত করতে পারে-সেই দূরদর্শী মৌল মননবৃত্তিগতবোধ গ্রন্থটির অন্তরাত্নায় সঞ্জীবনী প্রাজ্ঞতার আলো বিকিরণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদী কূটনৈতিক আর্থ-প্রণোদনা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে সমাজতন্ত্রের গুরুত্বহীনতার বিপরীতে গণতান্ত্রিকতার প্রকৃত দেশপ্রেমিক অন্তর্বৃত্তি কীভাবে স্বচ্ছ গণনেতৃত্বকে বিশ্বায়নবিরোধী স্বাদেশিকতাবোধের ঐক্যমঞ্চে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পৃক্ত বোধের মর্মমূলে প্রকৃত দৈশিকবোধকে আন্তর্জাতিকতায় জারিত করতে পারে এবং আন্তগর্বিত জাতি হিসেবে বাংলাদেশ নয় শুধু, তৃতীয় বিশ্বের যে কোন দেশকে মেধাবী প্রণোদনায় উচ্চকিত করতে পারে মানুষের রেনেসাঁ (Renaissance) বা চিত্তগত পুনর্জাগরণের সামগ্রিকতাবোধের প্রেক্ষাপটে এই গ্রন্থে তা অর্ন্তদৃষ্টিতে নিরীক্ষিত হয়েছে।
রহমান হাবিব-এর ‘আল মুজাহিদী: মৃত্তিকার কবি গ্রন্থটি হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসঐতিহ্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-নৃতত্ত-রাজনীতি ও সমাজ - প্রভৃতি বিষয়ের প্রজ্ঞাগত সংশ্লেষণকে সামগ্রিকতার দর্শন হিসেবে মূল্যায়নের প্রয়াস। উল্লেখ্য যে, বাঙালির কাব্যদর্শনভাবনার অনুচিন্তনকে উভয়বঙ্গে এভাবে কেউ ইতিপূর্বে আলােকপাত করেননি। কবিতার আবেগ, অনুভূতি, প্রেম ও নিসর্গচেতনার সঙ্গে জীবনের বহুরৈখিক বিষয়ব্যাপ্তির প্রাজ্ঞতার দর্শনকে এ গ্রন্থে নবতর দৃষ্টিতে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে । চর্যাপদের কবিতা থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবিতাসহ উনিশ শতকের আধুনিক কবিতার পথ-পরিক্রমা পার হয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশকের বৈশ্বিক কাব্যচেতনামূলক কবিতাসমেত বাংলাদেশের চল্লিশ থেকে আশির দশকের কবিতাসহ গত শতাব্দীর নব্বই দশকের কবিতার সংক্ষিপ্ত রূপরেখাভিত্তিক পর্যালােচনা সম্পৃক্ত জীবনের বহুমুখী প্রজ্ঞাচেতনার সামূহিকতার দর্শনকে এ গ্রন্থে পর্যবেক্ষণ করা কয়েছে । ষাটের দশকের কবি আল মুজাহিদীর কবিতায় মৃত্তিকা, স্বদেশ, নারীচেতনা, সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ববােধ, নান্দনিকতা, নৈতিকতা, ইহলৌকিকতা এবং স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসসহ সত্যের প্রতি অবিচলতা এবং মানবের সম্ভাবনার প্রতি ইতিবাচক আশ্বস্ততা অভিব্যক্ত হয়েছে। তাঁর কবিতার সে দৃষ্টিভঙ্গিসমূহকে দর্শনভাবনার সম্পৃক্ততায় এ গ্রন্থে নিরীক্ষা করা হয়েছে। যে কোন শিল্পীর দর্শন মূলত মৃত্তিকা ও মানবকে কেন্দ্র করেই বিনির্মিত হয় । কবি আল মুজাহিদীর কবিতার দর্শন মৃত্তিকানির্ভর বলেই গ্রন্থের উপযুক্ত নামকরণ।