নীতিহীনতা মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর বিশাল আমাদের মহাবিশ্ব বা কসমস। কসমস মানে হচ্ছে জানার যোগ্য এক বিশ্ব। ২৫শ বছর আগে পিথাগোরাস উদ্ভাবিত এক শব্দ। আমরা সকলেই এই মহাবিশ্বের অংশ। প্রাত্যহিক ভাবনা থেকে মহাজাগতিক ভাবনা অতিদূরের বলে মনে হয়। অথচ আমরা জন্মেছি এ থেকে, আমাদের নিয়তিও এর সঙ্গে যুক্ত। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মৌলিক এবং পেছনের তাৎপর্যহীন অতি সাধারণ ঘটনার সবকিছু এই মহাবিশ্ব ও তার উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের কারণেই মহাবিশ্বের বিকাশ উন্মুখ সৌন্দৰ্য উপলব্ধির একটি পথ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞান আমাদের জানায় যে, স্থানকালের চতুর্মাত্রিক বিশ্বের ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠে কোনো কেন্দ্র বা প্রান্ত নেই। যা মানুষের মধ্যকার হায়ার্কি বা উচ্চ বা নিম্নশ্রেণি হওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলে, সাম্যের কথা বলে। আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে নীতিনৈতিকতার ভিত্তিভূমি হিসেবে বিবেচনা করতে পারলে ভালো হতো। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ময়দানে এক পাশে পাণ্ডবরা। আরেক পাশে কৌরবরা। তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে এলেন পাণ্ডব পুত্র অর্জুন। উভয় পক্ষ শঙ্খ বাজিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এগিয়ে গিয়ে অর্জুন প্রতিপক্ষদের দেখে বিমর্ষ। তাঁর শরীর কাঁপছে, হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। কারণ, শত্রুপক্ষে দাঁড়িয়ে যারা যুদ্ধ করতে এসেছে, এরা সবাই তাঁর আত্মীয়। তিনি কি করে সজ্ঞানে আত্মীয়দের হত্যা করেন? তাঁর রথ চালাচ্ছিলেন কৃষ্ণ। ঠিক এই সময়, মহাভারতের কবি অর্জুনের মুখে কয়েকটি প্রশ্ন তুললেন, আত্মীয়দের হত্যা করে। কল্যাণ কী করে সম্ভব? যে স্বজনদের জন্য রাজ্যকামনা, সেই স্বজনরাই যদি না থাকে তবে সেই রাজ্যের কি দরকার? এ অন্যায়, পাপ সেখানে নৈতিকতার জয়ই-বা কোথায়? নৈতিকতার জয়তো সহনশীলতা আর মিলেমিশে থাকার মধ্যে। যেনতেনভাবে স্বার্থসিদ্ধির যে প্রবণতা দুনিয়াজুড়ে চলছে, অধিক লাভের আশায় যাচ্ছেতা করা যেখানে স্বাভাবিক, পুঁজির দাপটে নীতিনৈতিকতা যেভাবে দুর্বলের You sent পরিচায়ক হয়ে উঠছে, সেই প্রেক্ষাপটে মহাভারতের কবি বেদব্যাসের এই কাহিনীর প্রাসঙ্গিকতা লক্ষণীয়। আরেকটি কথা না বললেই নয়, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে যাদের বিচার করা হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ দাবি করেন যে, তারা কোনো অপরাধ করেননি। তারা কেবল ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করেছেন। এই একই যুক্তি দেখিয়েছিলেন হিটলারের প্রধান আমলা আইচম্যানও। একটি রাষ্ট্রের যখন কোনো কিছুই নিয়ম অনুযায়ী চলে না, তখন এই যুক্তির কথাটাই ঘুরেফিরে চলে আসে। কর্মকর্তারা কেবল উর্ধ্বতনদের নির্দেশ পালন করেন। তারা কোনো আইন বা নীতিনৈতিকতা মেনে চলেন না। বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশে তাই নীতিনৈতিকতার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যুক্তি-তর্কের বৈপরীত্যে না গিয়ে আমরা নীতিনৈতিকতার একটি বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। এই ফেসবুক বা ইউটিউবের যুগে, যেখানে মুহূর্তে একজন মানুষের বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে খুব দ্রুত। তা যদিও বৃহত্তর অর্থে পৃথিবীর বৈষম্য বা বিশৃঙ্খলা কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোথাও কোথাও ‘(আরব) বসন্ত' আনলেও, তা মূলত এক কর্তৃত্ববাদীর হাত থেকে ক্ষমতাকাঠামো অধিকতর কর্তৃত্ববাদীর হাতে তুলে দিচ্ছে। ক্রমে মানুষের চিন্তা ও জীবনযাপনের স্বাধীন প্রকাশ সংকুচিত হচ্ছে। করোনা মহামারিকে পৃথিবী থেকে বিতাড়িত করতে রাষ্ট্রগুলো যথেষ্ট তৎপর। অথচ, আমরা দিব্য চোখে দেখছি, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর এক মহামারী নীতিহীনতা। একে দূর করতে তো রাষ্ট্রগুলো উদ্যোগ নিচ্ছে না। নীতিনৈতিকতাবর্জিত এই বিশ্বের ভবিষ্যৎ দেখে আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীও বলেছিলেন, 'মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নৈতিকতার চর্চা করে যাওয়া। কর্মক্ষেত্রে একমাত্র নৈতিকতাই এনে দিতে পারে জীবনের সৌন্দর্য ও মর্যাদা। মহাজগতের বিস্তৃত ভাবধারা থেকে আমাদের এই প্রয়াস নৈতিকতার বিষয়গুলো বড় পরিসরে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এই আশাই আমাদের সামনে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেবে।