বাঙালির সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও দর্শনচর্চার ইতিহাসে উনিশ শতক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়; আর এই শতকে উদ্ভূত যে কয়টি ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন বাঙালির চিন্তা চেতনায় সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলো, ব্রাহ্মসমাজ তাদের অন্যতম। এর প্রতিষ্ঠার মূলে ছিলেন নবযুগের প্রবর্তক, আধুনিক যুগ-সারথি রাজর্ষি রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩)। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ব্রহ্মোপাসনার জন্য তিনি এই সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক বৃহৎ ধর্মীয় মিলন-ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন বাঙালিকে চিরাচরিত প্রথার দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে, অন্যায় অসঙ্গতি থেকে দূরে রাখতে এবং আত্মপ্রত্যয় ও ব্যক্তিগত বিবেক বুদ্ধির ওপর ধর্মবোধকে একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন চর্যা রূপে প্রতিষ্ঠা করতে। সাম্যাদর্শের এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জোড়া-সাঁকোর রামকমল বসুর বাড়ির কিয়দংশ মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ তথা ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমাজের আদর্শ ছিলো সাম্য, লক্ষ্য মানুষের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ। এই আদর্শ ও লক্ষ্যই উত্তরকালে বাঙালিকে মানবতাবাদী দর্শন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে। রামমোহনের এই সমন্বয়বাদী ধর্মচিন্তা নিয়ে আলোচনা করাই আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। তবে এর আগে রামমোহনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সংক্ষেপে দু'একটা কথা বলা প্রয়োজন।