প্রাগৈতিহাসিক যুগের আদিম অবস্থা হইতে শুরু করিয়া আজিকার সমাজতন্ত্র পর্যন্ত নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়া সমাজের বিকাশ হয়। আদিম যুগ এবং সমাজতন্ত্রের দীর্ঘ ব্যবধানের মধ্যে দেখা দেয় প্রথমত গোলামী ব্যবস্থা বা দাস যুগ, তারপর সামন্ততন্ত্র বা ভূমিদাস প্রথা, সর্বশেষে পুঁজিতন্ত্র। আদিম সমাজে শ্রেণী-বৈষম্য ছিল না: সমাজতন্ত্রেও শ্রেণী-বৈষম্য নাই। শ্রেণী-বৈষম্য মাঝের সমাজগুলিরই বিশেষত্ব। প্রত্যেকটি সমাজের কাঠামো অপরটি হইতে ভিন্ন সমাজের এই রূপান্তর হইয়াছে কিরূপে, কোন্ সূত্র অনুসারে? সমাজের বিকাশের সূত্র আবিষ্কার করেন কার্ল মার্কস। খাওয়া-পরার জন্য উৎপাদন করিতে হয় সকলকেই; কিন্তু উৎপাদনের জন্য দরকার উৎপাদনের হাতিয়ার বা যন্ত্র। পশুরও খাইতে হয়। বাঁচিয়া থাকার জন্য আহার সংগ্রহ করিতে হয়। কিন্তু হাত পা-ই তাহার হাতিয়ার; নিজের স্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই পশু খাদ্য আহরণ করে। কিন্তু মানুষের বেলায় হাত হয় না। কৃত্রিম হাতিয়ার দ্বারা মানুষ তাহার স্বাভাবিক হাতকে সম্পূরণ করে। এইখানেই মানুষের সঙ্গে পশুব জগতের প্রভেদ: কৃত্রিম হাতিয়ারের বহার হইতেই মানুষের সমাজের শুরু। উৎপাদনের জন্য যে হাতিয়ার বা উপকরণ দরকার, তাহাকে বলা হয় উৎপাদন শক্তি। আর উৎপাদনের কাজে মানুষ মানুষের সঙ্গে যে সব সম্পর্কে আবদ্ধ হয় তাহাকে বলা হয় উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদনশক্তির অনুরূপই হয় উৎপাদনসম্পর্ক। আদিম সমাজে পাথরই ছিল হাতিয়ার; পাথর দ্বারা একমাত্র শিকার করাই সম্ভব। কিন্তু শিকার করিতে হইলে যাইতে হয় জঙ্গলে; একা যাওয়ার উপায় নাই, দল বাঁধিয়া, সকলে মিলিয়া যাইতে হয়। শিকার সহজলভ্য নয়, পাওয়া যাইত কম। তাই সকলে সমানভাবে শিকারের অংশ লইত। উৎপাদন শক্তি মোটেই বিকাশলাভ করে নাই: আদিম মানুষের সম্পর্কের মধ্যে তাই কোন অসমতা দেখা দেয় না; সকলকেই কাজ করিয়া খাইতে হইত। কিন্তু উৎপাদনশক্তির যখন আরও বিকাশ হয়, তামা-লোহা প্রভৃতির আবিষ্কার হয়, তখন খাদ্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়। শুধু তাহাই নয়, মানুষ মানুষে অসমতাও সৃষ্টি হয়। কতক লোক শুধু উৎপাদনের উপায় বা যন্ত্রাদির মালিক, ইহারা কাজ না করিয়াও পারে। কিন্তু আর সব হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খাটে। উৎপাদন সম্পর্ক বদলাইয়া যায়। সমাজে শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। উৎপাদনশক্তির কিরূপ বিকাশ হইয়াছে, তাহার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়াই গড়িয়া উঠে উৎপাদন সম্পর্ক। কিন্তু এই সামঞ্জস্য বেশিদিন থাকে না। যতই উৎপাদনশক্তির বিকাশ হয় ততই উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে উহার বিরোধ বাধে। একটা সময় যখন উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদনশক্তির বিকাশের পথে বাধা জন্মায়। ইহাই সমাজবিপ্লবের অবস্থা। তখন সমাজে যে-শ্রেণী পরিবর্তনবিরোধী এবং যে-শ্রেণী পরিবর্তনপ্রয়াসী তাহাদের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়।
বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নির্মাতা ছিলেন আজন্ম বিপ্লবী রেবতী বর্মণ। তিনি ১৯৫২ সালের ৬ই মে মারা যান। জন্মেছিলেন ১৯০৩ সালে। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৭ বছর। তার নিজ গ্রামের মানুষদের কাছে রেবতীবাবু বলে পরিচিত ছিলেন। আর আমাদের কাছে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ বইয়ের লেখক হিসেবে পরিচিত। যে বইটি ১৯৫২ সাল থেকে এ উপমহাদেশের বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও কর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় বই। সেই অমর গ্রন্থের নাম হলাে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ। ব্রিটিশ-ভারতের জেলে থাকাকালীন সময়ে ব্রিটিশ সরকার রেবতী বর্মণের উপর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন করে। যে কারণে তিনি ঘাতকব্যাধি কুষ্ঠে আক্রান্ত হন। ১৯৪৯ সালে নিজ জন্মভূমি ভৈরবে বসে কুষ্ঠরােগাক্রান্ত পচন ধরা আঙুলে রশি দিয়ে হাতের সঙ্গে কলম বেঁধে রচনা করেন সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ।