ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর পুরো জীবনে যতগুলো কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেছেন তার মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ হল আল আযকার। যার পুরো নাম: الاذکارالمنتخبة من کلام سیدالابرار-আল আযকারুল মুন্তাখাবাতু মিন কালামি সাইয়িদিল আবরার তথা হাদিসে বর্ণিত নির্বাচিত দুআ,যিকির ও আমলসমূহ।বইটির নাম থেকেই পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে মানবজীবনে বইটি আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ নিজে বইটি সম্পর্কে তার ভূমিকায় লিখেছেন,হাদিসে বর্ণিত দৈনন্দিন দুআ,যিকির ও আমল বিষয়ে সালাফগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন।তবে সেগুলোতে হাদিসের সনদ ও একই হাদিস বারবার উল্লেখ হওয়ায় বইগুলো অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে।সহজেই একজন পাঠক সেগুলো থেকে উপকৃত হতে পারে না।তাই আমি সহিহ হাদিসে বর্ণতি দৈনন্দিন দুআ,যিকির ও আমল বিষয়ে এমন একটি গ্রন্থ রচনা করার মনস্থ করেছি যাতে একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু-জীবনের প্রতিটি ধাপে হাদিসে বর্ণিত দৈনন্দিন দুআ,যিকির ও আমলসমূহ উল্লেখ থাকবে।হাদিস চয়নের ক্ষেত্রে আমি হাদিসের প্রশিদ্ধ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কিতাব সহিহ বুখারি, মুসলিম , তিরমিযি , নাসাঈ ও আবূ দাউদকে প্রাধান্য দিয়েছি।এবং হাদিসের অন্যান্য প্রশিদ্ধ কিতাব থেকেও দুআ-যিকির ও আমল বিষয়ে সহিহ হাদিসগুলো নিয়ে এসেছি। বইটিতে আমি সহিহ হাদিসগুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।হাদিস বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে প্রয়োজনীয় মাসাইলেরও আলোচনা করেছি। বইটি প্রণয়ণের পর থেকে অধ্যাবধি পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত।বইটিকে সংক্ষিপ্ত দুআ,যিকির ও আমল বিশ্বকোষও বলা যেতে পারে। এক কথায় একজন মুমিন কিভাবে তার পুরোটা সময় সঠিকভাবে সুন্নাহ মাফিক কাটাবে এটাই এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ (۱۵۲) অনুবাদ: অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। যিকির আরবী শব্দ। এর বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে – (১) মুখ থেকে যা উচ্চারণ করা হয়। (২) অন্তরে কোন কিছু স্মরণ করা। (৩) কোন জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করা। শরয়ী পরিভাষায় যিকির হচ্ছে, বান্দা তার রবকে স্মরণ করা। হোক তা তাঁর নাম নিয়ে, গুণ নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে, প্রশংসা করে, তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে, তাঁর একত্ববাদ ঘোষণা করে, তাঁর দেওয়া বিধি-বিধান আদায় করে, তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে অথবা তাঁর কাছে কিছু চেয়ে। যিকির দুই প্রকার। যথা – কওলী বা কথার মাধ্যমে যিকির ও আমলী বা কাজের মাধ্যমে যিকির। প্রথম প্রকার যিকিরের মধ্যে রয়েছে – কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহ্র সুন্দর সুন্দর নাম ও সিফাতসমূহের আলোচনা ও স্মরণ, তাঁর একত্ববাদ ঘোষণা ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় প্রকারে রয়েছে – ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেয়া, আল্লাহ্র হুকুম-আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি। প্রথম প্রকার যিকিরের মধ্যে কিছু যিকির আছে যা সময়, অবস্থা এবং সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সকাল ও সন্ধ্যার যিকির, সালাতের পরের যিকির, খাওয়ার শুরু-শেষ, কাপড় পরিধান, মসজিদে প্রবেশ-বাহির ইত্যাদি সহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ-কর্মের দুআ বা যিকিরসমূহ। وما خلقت الجن والانس الا لیعبدون (الذریات٥٦) অনুবাদ: আর আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্যেই যে, তারা কেবল আমার ইবাদাত করবে। মূলত বান্দার সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে চিনার জন্যই ।এজন্য হাদিসে বর্ণিত দুআ, যিকির-আযকার ও আমল করা মুমিনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কাজ । কেননা এর দ্বারা একজন মুমিন তার স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করার তাওফিক দান করুন।
তাঁর পূর্ণনাম মুহিউদ্দ্বীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনুশ শায়েখ আবু ইয়াহইয়া মুররি ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জুম‘আ ইবনে হেযাম আল-হেযামী আন-নববী। ‘মুহিউদ্দ্বীন’ তাঁর উপাধি এবং ‘আবু যাকারিয়া’ হলো কুনিয়াত তথা উপনাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদণ্ডে এমন সমুন্নত হতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ‘মুহিউদ্দ্বীন মতান্তরে ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৬৩১ হিজরীর মুহাররম মাসে দামেশকের নিকটবর্তী ‘নাওয়া’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের দিকে সম্পর্কিত করেই তাঁর নামের শেষে ‘নাওয়ায়ী’ বা ‘নববী’ উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর যেসব বান্দাদের দিয়ে দীন ও মানুষের মহান খেদমত করান, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে থেকেই তিনি ছিলেন আর সব শিশুদের চেয়ে আলাদা। অজপাড়া গ্রামে, নিম্নবিত্ত নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও তাঁর সবটুকু ঝোঁক ছিলো ইলম অর্জনের দিকে। দোকানদার পিতা চাইতেন, ছেলে তার সাথে দোকানদারী করুক। কিন্তু তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দামেশকের ‘আর-রাওয়াহিয়্যাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানে চলে যান ইলমের-অšে¦ষণে এবং আলেমদের সংস্পর্শে থাকার তাড়নায়। এখানে থেকেই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় নিজের উত্তরোত্তর ব্যুৎপত্তি ঘটান। ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (নববী) দিন-রাত্রির বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জনে ব্যয় করতেন। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য তাঁকে দিয়ে উদাহরণ পেশ করা হতো।’ সারাদিনে একবার খেতেন। এমনকি পথ চলার সময়টুকুতেও মনে মনে পড়া আওড়াতেন। ৬৫১ হিজরীতে একুশ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জ পালন করার জন্য মক্কায় যান। এই সফরকালে তিনি মক্কা-মদীনার শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সান্নিধ্যে আসেন এবং হাদীস শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ যেসব ওস্তাদদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-মাকদাসী, ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম, আহমদ ইবনে আবদুদ্দায়েম, আবদুর রহমান আল-আন্বারী, ইবরাহীম ইবনে আলী আল-ওয়াসেতী প্রমূখ অন্যতম। ফিকহের ক্ষেত্রে নববী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শুধু অনুসারীই নয়, বরং তিনি ছিলেন মাযহাবের প্রধান বিশ্লেষক ও ইমামদের একজন। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন শায়খুল মাযহাব এবং তাঁর যমানার শ্রেষ্ঠতম ফকীহ’। যাহাবী বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাযহাবের ব্যাখ্যাকারদের শিরোমনি’। তাঁর রচিত ‘রাওদাতুল ত্বালেবীন’কে শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ শাফেয়ী আলেমদের মতো ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহও আকীদার ক্ষেত্রে ‘আশ‘আরী’ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যাহাবী, তাজউদ্দীন সুবকী, ইয়াফেয়ী-সহ তাঁর অপরাপর জীবনীকাররা এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে তিনি আশ‘আরী মতবাদসমূহকে ব্যাপকভাবে স্থান দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাত্মা বেঁচে ছিলেন মাত্র পয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে দিয়ে দীন ও ইলমের যে বিশাল খেদমত করিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তাঁর রচিত গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে উপকার দিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! বিশেষ করে ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’, ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এবং ‘আল-আযকার’ এই তিনটি গ্রন্থ তো সর্বস্তরের মুসলিমের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত এবং পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, (১) আল-মিনহাজ ফি শারহে মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ; (২) রাওদাতুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৩) মিনহাজুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৪) আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি; (৫) তুহফাতু তুল্লাবিল ফাদায়েল; (৬) আত-ত্বিবইয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কুরআন। (৭) আত-তাহরীর ফি আলফাযিত তানবীহ; (৮) আল-উমদাহ ফি তাসহিহিত তানবীহ; (৯) আল ইদ্বাহ ফিল মানাসিক; (১০) আত তাইসীর ফি মুখতাসারিল ইরশাদ; (১১) ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বায়েক; (১২) আল-ফাতাওয়া; (১৩) আল মিনহাজ ফি মুখতাসারিল মুহাররার; (১৪) দাকায়েকুল মিনহাজ; (১৫) মুখতাসারু আসাদিল গাবাহ; (১৬) মানাকিবুশ শাফেয়ী; (১৭) মুহেম্মাতুল আহকাম; (১৮) রিসালাহ ফি ক্বিসমাতিল গানাঈম; (১৯) খুলাসাতুল আহকাম; (২০) বুসতানুল আরেফীন। এছাড়া তাঁর রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে ‘আল মাজুমু শারহুল মুহায্যাব’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সুবকী রাহিমাহুল্লাহ এবং তারপর শায়েখ মুহাম্মদ নজীব এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। এছাড়া ‘জামেউস সুন্নাহ’, ‘শারহুত ত্বানবীহ’, ‘শারহুল ওয়াসিত’, ‘শারহুল বুখারী’, ‘শারহু সুনানি আবু দাউদ’, ‘আল-আহকাম’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ৬৭৬ হিজরীর রজব মাসের চব্বিশ তারিখে পয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাজউদ্দীন সুবকী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দামেশক ও তদ্সংলগ্ন শহরগুলো শোকে ডুবে গিয়েছিলো।’ জন্মস্থান ‘নাওয়া’তেই তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করুন।