আমাদের অনূদিত রিয়াযুস সালিহিন-এর বৈশিষ্ট্য মুহিউদ্দিন নববি রহ. ছিলেন হিজরি সপ্তম শতকের ক্ষণজন্মা মুহাদ্দিস ও হাদিসশাস্ত্রের সর্বজনস্বীকৃত ইমাম। রিয়াযুস সালিহিন তাঁর সংকলিত সর্বাধিক পঠিত, ব্যাপক সমাদৃত ও কালজয়ী একটি গ্রন্থ; যা বিগত সাতশ বছর ধরে নানা শ্রেণির পাঠকের জ্ঞানপিপাসা ও আত্মার ক্ষুধা নিবারণ করে আসছে। পরিপূর্ণ দ্বীন মানতে আগ্রহী একজন মুসলিম ব্যক্তির জীবনের যেসব বিষয়ে জানা জরুরি, ইমাম নববি রহ. আলোচ্য গ্রন্থটিতে সে ধরনের প্রায় সকল বিষয়ের শিরোনাম রেখেছেন এবং প্রতিটি শিরোনামের অধীনে উক্ত বিষয়-সংশ্লিষ্ট কুরআনের আয়াত ও হাদিসে নববির সমাহার ঘটিয়েছেন। হাদিস গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে নাসায়ি,সুনানে আবু দাউদ,সুনানে ইবনে মাজাহ,জামেয়ে তিরমিজি, ও মুআত্তা মালেকের ন্যায় নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থসমূহকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এসব বিশেষত্বের কারণে অন্য অনেক পাঠকনন্দিত গ্রন্থের ন্যায় রিয়াযুস সালিহিন বইটিও পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়াজাগিয়েছে। আমাদের এই অনুবাদগ্রন্থটি বেশ কিছু কারণে ভিন্নতা ও অনন্যতার দাবিদার। যেমন : ০১- অনুবাদক যেহেতু দীর্ঘদিন যাবৎ ‘আরবি ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে পাঠদানের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাই আরবির ওপর তাঁর বেশ ভালো দখল রয়েছে। আশা করা যায়, এ কারণে প্রতিটি হাদিসের অনুবাদ বিশুদ্ধ ও মূলানুগ হওয়ার পাশাপাশি যথেষ্ট ঝরঝরে ও সুখপাঠ্য হয়েছে। ০২- অনুবাদক মুফতি আব্দুল মালেক সাহেব হাফিযাহুল্লাহ এর পরিচালিত মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকায় দু-বছর (২০০৯-১০ খ্রি.) উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন। তাই হাদিস নিয়ে গবেষণা করা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।"রিয়াযুস সালেহিন" বইটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তার গবেষণার অনেককিছুই ফুটে উঠেছে। ০৩-শুধু অনুবাদ পাঠ করে যেসব হাদিসের মর্ম উপলব্ধি করা যায় না, টীকায় সেসব হাদিসের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে এবং পূর্বসূরি মুহাদ্দিসিনে কেরামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোকে অল্প কথায় হাদিসের মর্ম সহজবোধ্য করে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ০৪- রিয়াযুস সালিহিন গ্রন্থে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম ছাড়াও অন্য কিছু হাদিসগ্রন্থ থেকে প্রচুর হাদিস সংকলন করা হয়েছে। সময়ের দাবি ও চাহিদা ছিল অনুবাদের পাশাপাশি সেসব হাদিসের তাহকিক তথা হাদিসের মান ও তাখরিজ তথা হাদিসের সূত্র উল্লেখ করে দেওয়া। আমাদের অনূদিত গ্রন্থটিতে নিকট-অতীতের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শায়খ শুয়াইব আরনাউত রহ.-এর তাহকিক অনুসরণপূর্বক সেসব হাদিসের মান ও তাখরিজ উল্লেখ করা হয়েছে। ০৫- সংকলিত প্রতিটি হাদিসের মূলসূত্র ও মূল গ্রন্থের হাদিস-নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে একজন পাঠক চাইলেই এই গ্রন্থে বিদ্যমান যেকোনো হাদিস মূলগ্রন্থের বরাতে বর্ণনা করতে পারবেন। আমরা আশাবাদী, আমাদের প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থটি সম্মানিত ইমাম-খতিবগণসহ বাংলা ভাষাভাষী সর্বশ্রেণির পাঠকের ইলমি-রুহানি খোরাক জোগাতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।ইনশাআল্লাহ।
তাঁর পূর্ণনাম মুহিউদ্দ্বীন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনুশ শায়েখ আবু ইয়াহইয়া মুররি ইবনে হাসান ইবনে হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জুম‘আ ইবনে হেযাম আল-হেযামী আন-নববী। ‘মুহিউদ্দ্বীন’ তাঁর উপাধি এবং ‘আবু যাকারিয়া’ হলো কুনিয়াত তথা উপনাম। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি এতোটাই প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদণ্ডে এমন সমুন্নত হতে পেরেছিলেন যে, তাঁকে ‘মুহিউদ্দ্বীন মতান্তরে ‘মুহিউস্ সুন্নাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ৬৩১ হিজরীর মুহাররম মাসে দামেশকের নিকটবর্তী ‘নাওয়া’ নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানের দিকে সম্পর্কিত করেই তাঁর নামের শেষে ‘নাওয়ায়ী’ বা ‘নববী’ উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর যেসব বান্দাদের দিয়ে দীন ও মানুষের মহান খেদমত করান, ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে সেভাবেই গড়ে তোলেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে থেকেই তিনি ছিলেন আর সব শিশুদের চেয়ে আলাদা। অজপাড়া গ্রামে, নিম্নবিত্ত নিরক্ষর পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও তাঁর সবটুকু ঝোঁক ছিলো ইলম অর্জনের দিকে। দোকানদার পিতা চাইতেন, ছেলে তার সাথে দোকানদারী করুক। কিন্তু তিনি পিতার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দামেশকের ‘আর-রাওয়াহিয়্যাহ’ নামক প্রতিষ্ঠানে চলে যান ইলমের-অšে¦ষণে এবং আলেমদের সংস্পর্শে থাকার তাড়নায়। এখানে থেকেই তিনি ইলমের সবগুলো শাখায় নিজের উত্তরোত্তর ব্যুৎপত্তি ঘটান। ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি (নববী) দিন-রাত্রির বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জনে ব্যয় করতেন। মেধা ও পরিশ্রমের জন্য তাঁকে দিয়ে উদাহরণ পেশ করা হতো।’ সারাদিনে একবার খেতেন। এমনকি পথ চলার সময়টুকুতেও মনে মনে পড়া আওড়াতেন। ৬৫১ হিজরীতে একুশ বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জ পালন করার জন্য মক্কায় যান। এই সফরকালে তিনি মক্কা-মদীনার শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সান্নিধ্যে আসেন এবং হাদীস শাস্ত্রে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ যেসব ওস্তাদদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-মাকদাসী, ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম, আহমদ ইবনে আবদুদ্দায়েম, আবদুর রহমান আল-আন্বারী, ইবরাহীম ইবনে আলী আল-ওয়াসেতী প্রমূখ অন্যতম। ফিকহের ক্ষেত্রে নববী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। শুধু অনুসারীই নয়, বরং তিনি ছিলেন মাযহাবের প্রধান বিশ্লেষক ও ইমামদের একজন। ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তিনি ছিলেন শায়খুল মাযহাব এবং তাঁর যমানার শ্রেষ্ঠতম ফকীহ’। যাহাবী বলেন, ‘তিনি ছিলেন মাযহাবের ব্যাখ্যাকারদের শিরোমনি’। তাঁর রচিত ‘রাওদাতুল ত্বালেবীন’কে শাফেয়ী মাযহাবের প্রধানতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিকাংশ শাফেয়ী আলেমদের মতো ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহও আকীদার ক্ষেত্রে ‘আশ‘আরী’ মতবাদের অনুসারী ছিলেন। যাহাবী, তাজউদ্দীন সুবকী, ইয়াফেয়ী-সহ তাঁর অপরাপর জীবনীকাররা এমনটাই উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যায় তাঁর রচিত ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থে তিনি আশ‘আরী মতবাদসমূহকে ব্যাপকভাবে স্থান দিয়েছেন। ক্ষণজন্মা এই মহাত্মা বেঁচে ছিলেন মাত্র পয়তাল্লিশ বছর। কিন্তু এই স্বল্প সময়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে দিয়ে দীন ও ইলমের যে বিশাল খেদমত করিয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ইলমের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই তাঁর রচিত গ্রন্থ রয়েছে, যেগুলো কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে উপকার দিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ! বিশেষ করে ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’, ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এবং ‘আল-আযকার’ এই তিনটি গ্রন্থ তো সর্বস্তরের মুসলিমের কাছেই সমানভাবে সমাদৃত এবং পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হলো, (১) আল-মিনহাজ ফি শারহে মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ; (২) রাওদাতুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৩) মিনহাজুল ত্বালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন; (৪) আদাবুল মুফতি ওয়াল মুসতাফতি; (৫) তুহফাতু তুল্লাবিল ফাদায়েল; (৬) আত-ত্বিবইয়ান ফি আদাবে হামালাতিল কুরআন। (৭) আত-তাহরীর ফি আলফাযিত তানবীহ; (৮) আল-উমদাহ ফি তাসহিহিত তানবীহ; (৯) আল ইদ্বাহ ফিল মানাসিক; (১০) আত তাইসীর ফি মুখতাসারিল ইরশাদ; (১১) ইরশাদু তুল্লাবিল হাক্বায়েক; (১২) আল-ফাতাওয়া; (১৩) আল মিনহাজ ফি মুখতাসারিল মুহাররার; (১৪) দাকায়েকুল মিনহাজ; (১৫) মুখতাসারু আসাদিল গাবাহ; (১৬) মানাকিবুশ শাফেয়ী; (১৭) মুহেম্মাতুল আহকাম; (১৮) রিসালাহ ফি ক্বিসমাতিল গানাঈম; (১৯) খুলাসাতুল আহকাম; (২০) বুসতানুল আরেফীন। এছাড়া তাঁর রচিত অসমাপ্ত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে ‘আল মাজুমু শারহুল মুহায্যাব’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম সুবকী রাহিমাহুল্লাহ এবং তারপর শায়েখ মুহাম্মদ নজীব এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। এছাড়া ‘জামেউস সুন্নাহ’, ‘শারহুত ত্বানবীহ’, ‘শারহুল ওয়াসিত’, ‘শারহুল বুখারী’, ‘শারহু সুনানি আবু দাউদ’, ‘আল-আহকাম’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ৬৭৬ হিজরীর রজব মাসের চব্বিশ তারিখে পয়তাল্লিশ বা ছেচল্লিশ বছর বয়সে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাজউদ্দীন সুবকী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দামেশক ও তদ্সংলগ্ন শহরগুলো শোকে ডুবে গিয়েছিলো।’ জন্মস্থান ‘নাওয়া’তেই তাঁকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করুন।