বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি আলাদা নাম হলেও ইতিহাস কিন্তু একটি। ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক, এক ও অভিন্ন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পথিকৃৎ। বাংলাদেশে ইতিহাস রচনায় তিনি অবিসংবাদিত মহানায়ক, রাজনীতির মহাকবি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট, আটান্নের সামরিক সরকার বিরোধি আন্দোলন, ছিষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তুরের গণঅভুত্থানÑ প্রতিটি ইতিহাসের পরতে পরতে এক অবিসংবাদিত নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আয়োজন করেছে বিশেষ অধিবেশনের। এ অধিবেশনের কার্যক্রম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানাতে ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। এছাড়া জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অধিবেশনে জাতির পিতাকে সম্মান জানানোর মাধ্যমে আমরা নিজেরাও সম্মানিত হব। সীমিত সময় ও পরিসরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার জীবন ও কর্মের বিস্তৃতি এতটাই বিশাল যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি দিনের পর দিন আলোচনা করলেও তা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকানে ব্যক্তি ও পারিবারিক বন্ধন কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সব সময়ই বঙ্গবন্ধুকে তার চলার পথে সাহস জুগিয়েছেন, বিপদে ভরসা দিয়েছেন। নিজের ও পরিবারের চেয়ে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেছেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরণ সভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আমাদের আবাসভ‚মির নাম পূর্ব পাকিস্তান নয়, হবে বাংলাদেশ।” ইতোমধ্যে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ব বাংলা। পাকিস্তান সামরিক শাসক বাধ্য হয় সাধারণ নির্বাচন দিতে। অবশেষে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তা যেন অপূর্ণই থেকে যায়। সাত কোটি বাঙালি তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার আসার অপেক্ষায় ক্ষণ গুণতে থাকেন। অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৮ই জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন পৌঁছান। সেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ^বাসীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহŸান জানান। বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন। দিল্লিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু বিশাল এক জনসভায় বাংলায় বক্তৃতা করেন। শুরু হলো সদ্য স্বাধীন দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথ চলা। বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে পা রেখেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে নেমে পড়েন। তিনি কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, পর্যটন, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগসহ খাতভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভ‚মি সংস্কার, সেচযন্ত্র স্থাপন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, বেতবুনিয়া ভ‚-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন, টঙ্গীতে বিশ^ ইজতেমার জায়গা বরাদ্দ, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন এবং পঙ্গু হাসপাতাল স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে জাতি আজও পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সম-অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ক‚টনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতেও উদ্যোগী হন। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ক‚টনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনসহ ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং গরিব-দুঃখী মানুষের কল্যাণেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ^ শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ^ শান্তি পরিষদ তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভ‚ষিত করে। বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্রের উন্নয়নকেও সমান গুরুত্ব দিতেন। তাই ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তৎকালীন শাসকচক্রের চক্রান্তের জন্য সংসদে বসার সুযোগ হয়নি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে সংসদকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ রাষ্ট্রপতির ২২ নম্বর আদেশবলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম ‘গণপরিষদ’ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা এই পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম দিনের অধিবেশনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি হিসেবে বর্ষীয়ান নেতা মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর নাম প্রস্তাব করেন। তার সভাপতিত্বে গণপরিষদের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন এবং স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করেন। শাহ আবদুল হামিদ স্পিকার এবং জনাব মোহাম্মদউল্লাহ ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। গণপরিষদের প্রধান দায়িত্ব ছিল দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। আমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য প্রদানকারী মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদের মাননীয় সদস্যবৃন্দ, জাতীয় সংসদের সরকারি ও বিরোধী দলের মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দের মধ্য থেকে যারা বক্তব্যে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের বক্তব্যকে সংকলিত করে ‘পার্লামেন্ট ডায়ালগ’ গ্রন্থটির মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আশা করি আগামী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে জানার প্রচেষ্টা এই গ্রন্থটির মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ হবে। আমি বইটির সকল পাঠককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।