কিছু কথা হোক, যা বলা হয়ে উঠেনি কখনো, আজ আমার স্মৃতিগাছে ফুটেছে নানা কথার ফুল! যতনে তুলে নাও তাকে, বাকি সব না-হয় থাক বেঁচে, ছড়ানো ছিটানো, একদিন যেন সময়ের ডাকে না ফুরাক সব, এখানেই থেকে যাক স্মৃতিগাছ তাঁর কথার ফুল ফুটিয়ে অব্যয়, অক্ষয়। যে কথা মনের কথা, তখনকার যুগে নারী শিক্ষার ততটা প্রসার ছিল না। কিশোরী বয়সেই মেয়েদের ছাঁদনাতলায় ঠাঁই হতো। আমারও তাই হয়েছিল। হাইস্কুলে পড়াকালীন মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী-সংসার আর সন্তান লালন-পালনের মধ্যে ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয়। তবে পড়াশোনার একটা তাগিদ মন থেকে অনুভব করতাম সব সময়। আমার স্বামী প্রয়াত অমলেন্দু ঘোষ চৌধুরী ছিলেন বই পোকা, তেমনি গানপাগল। তাঁর কাছ থেকে পড়াশোনার প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি। বলতে গেলে একটা সময় প্রায় সবাই বলা চলে উপন্যাস, কবিতার বই-সহ নানা ধরনের বই পড়ায় আসক্ত ছিল। তখন তো আর এখনকার মতো বিনোদনের এত সমাহার ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সবাই বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকত। আমারও ছিল তাই। সংসারের কাজ সেরে যেটুকু সময় পেতাম নিয়মিত বই পড়তাম। সেই যে পড়তে শুরু করা, আজও বইকে নিয়েই ঘরকন্যা করছি আমি। এখন বয়সের ভারে পড়াশোনায় শরীর বেঁকে বসলেও মনের কাছে হেরে যায় প্রতিনিয়ত। বই পড়া ছাড়া বই লিখব কখনো ভাবিনি। জীবন সায়াহ্নে এসে একটা বিষয় আমাকে খুব ব্যথিত করেছে। আমার বই পড়ার হাতেখড়ি আমার পিতামহী শ্রীমতি মল্লিকা সুন্দরী’র কাছে। এই মহীয়সী নারীকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, দেখেছি তাঁর নারী শিক্ষা আর নারী স্বাধীনতা নিয়ে যে প্রাণপণ চেষ্টা তা আজও কারো মাঝে খুঁজে পাইনি। শুধু তাই নয় মানবতরার সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন আমৃত্যু। আজকের যে দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তা মল্লিকা সুন্দরী’র একক প্রচেষ্টায় আমাদের বাড়ির টিনের চালা ঘর থেকেই শুরু হয়েছিল। আজ তা স্থানান্তরিত হয়ে আমার বাবার বাড়ির পাশেই পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মল্লিকা সুন্দরী নামটি বেমালুম বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে! নতুন প্রজন্ম জানে না এতদ্অঞ্চলে তখনকার একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কারিগর ছিলেন আমার পিতামহী শ্রীমতি মল্লিকা সুন্দরী সরস্বতী। আর এই খেদ থেকেই বইটি লিখায় ব্রতী হলাম। আমি লেখক নই, ফলে লিখায় নানা অসংগতি, ভাষাগত অসামঞ্জস্য থাকবে। এটা আমার অক্ষমতাপ্রসূত। লিখায় আরো অনেকগুলো চরিত্র গল্পের প্রয়োজনে চলে এসেছে, এটা কেবলমাত্র আবেগপ্রসূত। আশাকরি পাঠক আমার অক্ষমতা ক্ষমায় সক্ষম করে তুলবেন। এই মহানুভবতার জন্য আমি পাঠকদের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে অবনত। আমার লিখায় সার্বিকভাবে সহায়তা করেছে আমার একমাত্র পুত্র অমিয়াংশু ঘোষ চৌধুরী অলক, জামাতা দেবদাস চৌধুরী, কন্যা তুলিকা ঘোষ চৌধুরী, নাতি সামির পল্লব এবং পুত্রসম শ্রীমান রাজীব চৌধুরী। তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই। বইটির প্রচ্ছদ করে দিয়েছে আমার পুত্রসম বাংলাদেশের খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী, আমার সুনামগঞ্জ জেলা তথা বাংলাদেশের গৌরব শ্রীমান ধ্রুব এষ। লিখা পাঠিয়ে আমায় ঋণী করেছেন কবি, ছড়াকার বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার জামাতা শ্রীমান তুষর কান্তি কর, আমার পুত্রসম লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক শ্রীমান গিয়াস আহমেদ। তাদের সবার জন্য আমার শুভাশিস এবং অন্তহীন ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। সুদীপ্তা ঘোষ চৌধুরী