রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থের প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্য এখানেই যে, জীবনের ক্ষণিকবোধের উজ্জীবনের কথা বলতে বলতে কবি এই গ্রন্থে বৃহত্তর মানব ও স্রষ্টাচৈতন্যের অসীমতাকে তাঁর কাব্য-দার্শনিক সজ্ঞায় (intuition) স্বাতন্ত্রিকভাবে বিধৃত করেছেন। 'ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থের ‘উদ্বোধন' কবিতায় কবি হালকা চালে তাঁর কাব্যানুভব অভিব্যক্ত করলেও মানবজীবন চলার পথের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততাকে তিনি অবলীলায় তাঁর কাব্যান্তরে সাবলীলভাবে স্থান দিয়েছেন। অকারণ পুলকে যদিও ক্ষণিকের গান কবি গাইতে চেয়েছেন এ কবিতায়, তাকে অকারণ না বলে সেটিকেই আসলে জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় বলে আমি মনে করি । জীবনে যা-ই আসুক, যা হবার হোক, যা বোঝা হয়নি তা না বোঝাই থাকুক, যা জুটেনি তা না-ই জুটলো—এমন একটি সহজভঙ্গিতে জীবনোপভোগের যে স্বতঃস্ফূর্ত উৎকাঙ্ক্ষা, তা-ই এ কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। যখন যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই আশা মিটিয়ে নিতে এবং যখন যা ফুরাতে চায়, সেটিকে তখন ফুরিয়ে দিতে এবং যা সহজভাবে জীবনের সামনে রয়েছে, সেটিকে বুকে স্থান দেয়ার অনুভব ব্যক্ত করে কবি বলেন : “ধরণীর ’ পরে শিথিল-বাঁধন ঝলমল প্রাণ করিস যাপন, ছুঁয়ে থেকে দুলে শিশির যেমন শিরীষ ফুলের অলকে। (উদ্বোধন) নদীর জলের মধ্যে পড়া আলোর ঝলকে ঝলকে জীবনের পথে প্রান্তরে ভারহীনভাবে ছুটে চলে শিথিল বাঁধনে ধরণীর জীবনকে প্রাণবন্তভাবে যাপন করার কথা বলে রবীন্দ্রনাথ আসলে জীবনের দুঃখময়তার গুরুভারকে একটি স্বাভাবিকতার স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে যাপনের দার্শনিক আকাঙ্ক্ষা (Philosophical Aspiration) অভিব্যক্ত করেছেন বলে আমি মনে করি। ‘ক্ষণিকা' কাব্যগ্রন্থের ‘যথাস্থান' কবিতায় কবি তাঁর গানের অর্থাৎ তাঁর কাব্যযাত্রার স্থান কোথায়, তা নির্ধারণের জন্যে তাঁর গানের মান, ত্রাণ বা মুক্তি এবং প্রাণময়তার সীমান্ত অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। নবীন ছাত্ররা অপাঠ্য সব বইয়ের চাপে যারা অখুশি; কর্তৃজনের ভয়ে তাদের কাব্যবোধের দোলনা কুলুঙ্গিতে তোলা রয়েছে—তাই সেখানেও কবির গানের স্থান হচ্ছে না। যারা কাব্যবোদ্ধা এবং সঙ্গীতপ্রেমিক—এমন সমঝদাররাই কবির গানের মূল্যায়ন করতে সমর্থ হবেন। তরুণযুগলেরা যেমন তাদের
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।