বর্তমান বিশ্বে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বাক্যটি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে বহুল প্রচারিত ও আলোচিত। মুসলিম সমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এমনি একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন ও প্রচেষ্টায় রত আছেন। যদিও তার বিরুধীদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। পৃথিবীতে প্রায় ষাটটি রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানদের দ্বারা শাসিত হলেও দূর্ভাগ্যবশত: এর কোনো একটিও পুরোপুরি আল্লাহর আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। একটি স্বাধীন দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, অথচ সে দেশটি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে না, তা কেবল তখনি সম্ভব, যখন সেখানকার অধিবাসী মুসলমানেরা জেনে-বুঝে ইসলামকে নিজেদের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে অথবা অজ্ঞতা ও উদাসীনতার দরুন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপটিই তারা হারিয়ে ফেলেছে। প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণটিই মুখ্য বলে আমি বশ্বাস করি। এদেশের সাধারণ মানুষ আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা পোষণ করেন। তারা রাসূল (সা.)-কে প্রাণাধিক ভালোবাসেন। আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনকে সম্মান করেন। কিন্তু তাদের সামনে ইসলামের প্রকৃত পরিচয়টুকু অনুপস্থিত থাকার কারণে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। সমাজে ইসলামের খাদেম হিসেবে যারা পরিচিত তারাও ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্ক একেবারেই অজ্ঞ বলেই মনে হয়। আবার ইসলামপন্থী শিক্ষিত সমাজের অল্প কিছুসংখ্যক ছাড়া এর বিরাট অংশটির কাছে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাটি অস্পষ্ট। ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদকেই তারা ইসলাম বলে মেনে নিয়েছেন। তবে আল্লাহর মেহেরবানী, বর্তমানে বাংলাদেশসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশেই এমন কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিত ব্যক্তি তৈরি হয়েছেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রদর্শিত ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ভিত্তিক একটি ইসলামী রাষ্ট্রের চিত্র অন্তরে ধারণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রাজ্ঞ ও যোগ্য নেতৃত্বে একদিন এ বাংলার জমিনে কালেমার পতাকা উড্ডীন হবে ইনশাআল্লাহ। এ আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছি। ‘রাষ্ট্র ব্যবস্থার ইসলামী রূপ ও তার প্রক্রিয়া’ বইটি সেই সকল ভাই-বোনদের লক্ষ্য করে লিখা আমার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস। যারা আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে মনে-প্রাণে ধারণ করেন এবং বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে রূপ দানের স্বপ্ন দেখেন। মুসলিম বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ব্যক্তি এ বিষয়ে অনেক বড় বড় ভলিয়মের বিখ্যাত সব পুস্তকাদি লিখে গিয়েছেন এবং লিখছেন। যেগুলো ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে এবং রেখে যাচ্ছে। তাঁদের সে সকল পুস্তকসমূহ অধ্যয়ন করে অর্জিত জ্ঞানটুকুর আলোকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সহজ ভাষায় বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকদের বুঝার উপযোগী করে উপস্থাপন করাই আমার এ বিনীত প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে লিখার ক্ষেত্রে আল-কুরান, হাদীসে রাসূল (সা.), সীরাতের বিভিন্ন গ্রন্থ, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.), আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (র.)-এর মতো জগৎ বিখ্যাত মনীষীগণের লিখা বিভিন্ন কিতাবের সহযোগিতা নিয়েছি। তাছাড়াও ইমাম আবু ইউসুফ (র.), ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানী (র.) আল্লামা ইউসুফ আল-কারদাভী (র.)-এর বিভিন্ন রচনা ও বক্তব্য থেকেও প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। আলোচ্য বইটিতে প্রথমত ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচয় এবং সৃষ্টি জগৎ ও মানুষ সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি কি? একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক বিশ্বাস, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং সে রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়সমূহের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আল-কুরআন ও হাদীসে রাসূল (সা.)-এর আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও তার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। বিশাল একটি বিষয়কে অত্যন্ত সংক্ষেপ ও সহজভাবে তুলে ধরার ফলে অনেক বিষয়কেই এড়িয়ে যেতে হয়েছে। তাছাড়া নিজের সীমাবদ্ধতা এবং ভুল-ভ্রান্তির স্বীকৃতি দিতেও আমি অকৃপণ। তাই কোনো শুভাকাক্সক্ষী বন্ধুর গঠনমূলক সমালোচনাকে আল্লাহর রহমত বলে স্বাগত জানাতে আমি সর্বদা প্রস্তুত। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য আমাকে গ্রাস করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ।