চিত্রাঙ্গদা (২৮শে ভাদ্র, ১২৯৯) এই ক্ষুদ্র কাব্যনাট্যটি রবীন্দ্রনাথের অপরূপ সৃষ্টি। বাহিরের দিক হইতে যেমন ইহা রচনা-শিল্পের পরাকাষ্ঠা বহন করিতেছে, ইহার অন্তরের ভাবানুভূতিও তেমনি নর-নারীর চিরন্তন যৌবন-সমস্যাকে অভিনব কাব্যে রূপায়িত করিয়াছে। যৌবনের একখানি পরিপূর্ণ রাগিণী যেন অনাহত শব্দে নিরন্তর হইয়া অন্তস্তল হইতে ঝংকৃত হইয়া উঠিয়া সৌন্দর্য ও প্রেমের নিত্যবাণীর অনুসরণে আমাদের হৃদয় ও বুদ্ধিকে চমৎকৃত করিতেছে। এই কয়খানি পাতা যেন এক অপূর্ব কল্পলোকের দ্বার আমাদের চোখের সামনে খুলিয়া দেয়—একটি জাগ্রত মনোরম স্বপ্নে আমাদের বোধ ও অনুভূতি আচ্ছন্ন হইয়া যায় । প্রথমে ইহার ভিতরের স্বরূপ ধরা যাক । ইহার অন্তরে একটা ভাব, তত্ত্ব বা আইডিয়া অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার মনোজগতের আলোড়ন ও কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যে রূপ ধরিয়া বিরাজ করিতেছে। নরনারীর পরস্পর আকর্ষণের মূলে যৌনপ্রবৃত্তির চরিতার্থতার একটা আকাঙ্ক্ষা আছে। সে আকাঙ্ক্ষা দেহ-সম্ভোগের সহিত জড়িত । এই আকাঙ্ক্ষা-তৃপ্তির জন্য নরনারী দেহকেই কামনা করে। দেহের সৌন্দর্য ও রমণীয়তা যাহার যত বেশি, তাহার আকর্ষণী- শক্তি তত প্ৰবল । রূপই তাই দেহকে লোভনীয় করে, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা বৃদ্ধি করে এবং দেহমিলনে একটা সার্থকতা দেয়। এই দেহসম্ভোগ নরনারীর আদিম অনুপ্রেরণা। ইহার মধ্যে যে একটা বিস্ময়কর উল্লাস ও নিবিড় আনন্দানুভূতি আছে, তাহা অনস্বীকার্য । তাই নরনারীর মিলনের জন্য এই ব্যাকুলতা—প্রেমের এই বিচিত্র লীলা । কিন্তু এই যে দেহ-কেন্দ্রিক মিলন-ব্যাকুলতা বা ভোগাকাঙ্ক্ষামূলক প্রেম, ইহাই কেবল নরনারীকে চরম তৃপ্তি, পরম সার্থকতা বা কোনো সত্যের সন্ধান দিতে পারে না । দেহের সৌন্দর্য বা রূপের প্রকাশ ক্ষণিকের, জরা-ব্যাধির হাতে তাহার হ্রাস-ক্ষয় আছে এবং তাহার প্রকাশ এই রকমের। তাই এই দেহ-কেন্দ্রিক মিলন ক্ষণস্থায়ী আনন্দ দেয়, এবং কিছুদিনের মধ্যেই ইহাতে একঘেয়েমি, অতৃপ্তি ও অবসাদ আসে। দেহের ঊর্ধ্বে যে হৃদয় আছে, যে অন্তরাত্মা আছে, তাহার সহিত দেহের মিলন হইলে, তবেই সেই মিলনের প্রকৃত সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা আসে। এই হৃদয়, এই অন্তরাত্মা চিরন্তন। ক্ষণিক চিরন্তনের সহিত যুক্ত হইলে, চিরন্তনের দ্বারা বৃহত্তর ও মহত্তর হইলে সে মিলন হয় সার্থক, প্রেম হয় পরিপূর্ণ ও সত্যকার। দেহের সৌন্দর্য যেমন আকর্ষণের বস্তু, হৃদয়ের সৌন্দর্য তাহা অপেক্ষা অধিক আকর্ষণের বস্তু, কারণ তাহা চিরন্তন। এই দেহ ও হৃদয়ের ক্ষণিক ও চিরন্তরেন মিলন হইলে প্রেম প্রকৃত সার্থকতা লাভ করে—রূপজ মোহ সত্যকার প্রেমে রূপান্তরিত হয়। এইটি মূলভাব । ইহার সহিত জড়িত হইয়া আছে আর একটি ভাব। নারীকে যথার্থভাবে পাইতে হইলে তাহাকে পত্নীরূপে, সহধর্মিণীরূপে পাইতে হইবে, কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভোগের পাত্রী করিয়া রাখিলে তাহাকে পাওয়া যায় না । গৃহ ও
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।