আত্রাই নদীর কোল ঘেষে গড়ে উঠা জনবসতি, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করা কবি এম আল মাহমুদ হাসানকে সেই অঞ্চলের কৃষ্টি কালচার ভীষণ ভাবে আকর্ষণ করতো সেই ছোট বেলা থেকেই। শান্ত ও ভাবুক প্রকৃতির এই কাব্য প্রতিভা, তাঁর ছেলে বেলা থেকেই নিজের মানসিক স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। তাই তো যখন বাবা বা মায়ের হাত ধরে প্রাথমিকে আসা যাওয়া, ঠিক তখনই তিনি তাঁকে প্রমাণ করতে সক্ষম হোন। সুন্দর হস্তলিপি সহ নানা বিধ প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে তুলে ধরেন এই প্রতিভাবান কবি। যখন কবিতা প্রতিযোগিতা বিভাগেও প্রথম হোন, তখন সবাই নতুন করে চিনেছিলেন এই উদীয়মান তরুণ প্রতিভাকে। সেখানে সহযোগী ছিলেন তাঁর পরিবার, বিশেষত বাবার উৎসাহে কাব্যিক আবহের পথ ধরে চলতে থাকা এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “জন্মদাত্রী” হলেও, তাঁর লেখার গতি ও প্রকৃতি বলে দেয় অনেক দূর যেতে পারবেন এই কাব্য প্রতিভা। কবি এম আল মাহমুদ হাসান ভাবনা ও আবেগের শাব্দিক স্কুরণ ঘটান সুনির্দিষ্ট কাব্যিক আবহে। ছন্দ, তাল লয়, রূপকল্প, চিত্রকল্প, প্রবহমানতা তাঁর লেখার অন্যতম সহগ। তিনি ছান্দিক আবহে কবিতার শরীর নির্মাণে যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি গদ্যেও তাঁর লেখাগুলো শৈল্পিক কারুকাজের বিচিত্র চিত্র নির্মাণে পারঙ্গম। কবি তাঁর জন্মদাত্রী গ্রন্থটির শিরোনামখ্যাত কবিতায় বলছেন— সম্মানিয়া ধৈর্যশীলা বিশ্বলোক জুড়ে, সহনীয়া সর্বসহা অসীমের পরে। (জন্মদাত্রী), এখানে কবি মা'কে ঈশ্বরের পরে স্থান দিয়েছেন এবং মা'ও সন্তানের জন্য তাঁর সকল স্বাধীনতা, সুখ স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে সন্তানে ন্যস্ত করেন। বিষয়টিকে কবি চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। সনেট কবিতাটি যথাযথ মনে হয়েছে আমার দৃষ্টিকোন থেকে। এছাড়াও কবির এই গ্রন্থে বাংলা ছন্দের তিন বৃত্তই স্থান করে নিয়েছে। কবিতাগুলোতে কবির শব্দ ব্যবহারের মুন্সিয়ানা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কবি বলছেন— সাদায় যুদ্ধ কালায় যুদ্ধ যুদ্ধ নানা রঙে, মেথর মুচি সাজে কর্তা আত্ব জায়া ঢঙে। (কবিতা—যুদ্ধ) কবি তাঁর যুদ্ধ কবিতায় সমসাময়িক সামাজিক পৃক্ষাপটকে সুনিপুণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন। যা তাঁর বুভুক্ষু কলমের অনন্য এক সৃষ্টি বলে আমি মনে করি। এভাবে কবি প্রেম, ভালোবাসা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, গ্রাম, দেশাত্ববোধক, আন্তর্জাতিক ঘটমান বিষয় নিয়ে লেখা কবিতাগুলোকে এই কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। যা পাঠে পাঠক বৈচিত্র্যময় কাব্যসুধার রস আস্বাদন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কবির বেশ কিছু কবিতা পাঠককে বেশ বিচলিত করবে এবং কবিকে নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে বাধ্য করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ছন্দ কবিতার সাথে সাথে কিছু আধুনিক গদ্য কবিতাও এই গ্রন্থকে আলাদা এক রূপ দিয়েছে। যে লেখাগুলোতে কবি মূল ভাবকে চমৎকার ভাবে আড়াল করতে সক্ষম হয়েছেন। যেখানে পাঠককে নতুন ভাবনার খোরাক জোগাবে নিশ্চিত। কবি বলছেন— রক্ত সমুদ্রে ভেসে উঠা বিশ্ববিবেক, রঙীন পৃথিবী ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্রে সাদা—কালো। (কবিতা— জাতিসংঘ ও বিশ্বমানবতা) কবিতাটিতে কবি বিশ্ব মোড়লদের কাছে বিশ্ব শান্তির অন্যতম নিয়ামক জাতিসংঘও যে কতো অসহায় এবং এর ফলে সৃষ্ট স্নায়ুযুদ্ধে দূর্বল রাষ্ট্র তথা জনগণ কতোটা লন্ডভন্ড, তা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। পরিশেষে এতোটুকু বলতে পারি, সাহিত্যের এই নব তুর্কি এম আল মাহমুদ হাসানের সুন্দর ভাবনাবহুল ও সাধনা লব্ধ কবিতাগুচ্ছে সমৃদ্ধ , "জন্মদাত্রী " কাব্যগ্রন্থটি সত্যি একটি পরিপক্ব কলমের অঁাচড়, তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো এই নবাগত কবির জন্য।