বিশখালী নদীর কোল ঘেঁষে সবুজে ঘেরা সুকন্যাদের গ্রাম। চারদিকে ধানক্ষেত। পাখির কুজন। সকাল বেলায় মেঠো পথ ধরে বালক বালিকারা গ্রামের পাঠশালা ও স্কুলে যায়। পথের পাশে গুল্মলতা, হারগুজির বন, বনের মধ্যে সন্ধ্যে বেলায় শেয়ালের ডাক। আবার নির্জনতা ভেঙ্গে ঘুঘুপাখি আর ডাহুকের ডাক ভেসে আসে। কৃষকেরা সারাদিন মাঠে কাজ করে লাউয়ের তাজা ডগা কেটে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরে। কৃষাণী মাটির চুলায় রান্না করে। এ মাটির দেশে তাদের নেই কোনো অসুখ-নেই কোনো বিলাসিতার বালাই। গোধূলি শেষ। সুকন্যার মা ঘরের ভেতরে নকশী কাঁথা সেলাই করছিলেন। হাতের কাজ রেখে সুকন্যাকে ডেকে বললেন, কোথায় রে মা সুকন্যা, সন্ধ্যাবাতী দে তুলশি তলায়। প্রদীপ দে, পড়তে বস ভাইকে নিয়ে। ঠাকুর যে পাটে বসলো। পিছনের বারান্দা থেকে সুকন্যা বলল, হ্যাঁ, মা আসছি। সুকন্যার মা ঘরের পেছনে পুকুর পাড়ে যায়। হঠাৎ পুকুর পাড়ের ঝোঁপের পাশে কি যেন একটা ছায়ার মতো নড়ে ওঠে। সুকন্যার মা হাক দিয়ে বলে, “কে? কে ওখানে? দিদি আমি, আমিন। ওখানে কি করছ এই সন্ধ্যাবেলা? দিদি, নতুন জলে মাছ উঠছে, কোচ দিয়া মাছ মারতে আইলাম, ভয় পাইয়েন না। এই অন্ধকারে মাছ চোখে দেখ আমিন ? বুঝলাম না! হ দিদি, দেখতাছি তো। যাই, বাজানে আবার চিন্তা করবো। বাড়ি যাই।” রাতে সবাই খেয়ে শুয়ে পরে। সুকন্যা আর তার ভাই স্কুলের পড়া শেষ করে শুতে যাবে ঠিক এই সময় বাড়িতে কুকুরের চিৎকার। তীব্র চিৎকারে সুকন্যার মা উঠে ঘরের কুপি (কেরোসিনের বাতি) নিভিয়ে কাঠের ঘরের ফাঁকা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ তাকানোর পর দেখতে পায় উঠানে পাঁচ/ছয় জন লোকের ছায়া আনাগোনা করছে। সুমিতা দেবী সুকন্যার বাবাকে ঘুম থেকে ফিসফিস করে ডেকে তোলে। সুকন্যার বাবা ইন্দ্রজিত। সে ঘরের ফাঁকা দিয়ে উঠোনে তাকায় কিন্তু ততক্ষণে ছায়াগুলো চলে যায়। কুকুর তখনও চিৎকার করতেই থাকে। সুমিতা দেবী মেয়ে আর ছেলে পান্থকে তাদের ঘরে শুইয়ে দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে চিন্তিত হয়ে পান বের করে সাজাতে থাকে আর কি এক অজানা আশংকায় গম্ভীর হয়ে যায়। ইন্দ্রজিত বাবু বিষয়টা খেয়াল করে। সুমিতা দেবীকে প্রশ্ন করে, “কি এত ভাবছ গো” ? না, ভাবছি মেয়েটা বড় হচ্ছে। লেখাপড়া শেষ করার আগেই যদি বিয়েটা দেওয়া যায়, একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি। ইন্দ্রজিত বাবু বলে, “কি যে বলো! মাত্র নাইনে উঠলো মেয়েটা, এত ছোট মেয়েকে কি কেউ বিয়ে দেয়? হুম তা ঠিক। কিন্তু গ্রামের লোকজন অনেকেই মেয়েটা স্কুলে যাবার সময় হা করে তাকিয়ে থাকে। ভয় হয় তাই বলছি। আমি তো ‘মা’। চিন্তা হয়। তুমি বুঝবে না। ইন্দ্রজিত বাবু, কি বলো! আমার মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস এই গ্রামে কার আছে বলো তো ? এখন অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবে চলো, বাজে চিন্তা কর না।