গড়াই নদীর তীর বিধৌত দোলতপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার ও সমাজসেবী গুল আফরোজ আহমেদ শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। তবে অত্যন্ত প্রতগিশীল মনের অধিকারী তাঁর মা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ভাইবোনদের মতো কবিকেও ভীষণ ভাবে উৎসাহিত করেন জীবনকে সামনে এগিয়ে নিবার ক্ষেত্রে । বিধায় কবি ছোট বেলা থেকেই শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের পথে নিজেকে এগিয়ে নিতে থাকেন, যেখানে মায়ের চমৎকার সাহচর্য পেয়েছেন তিনি। সাহিত্যপ্রেমী এই কবি তাঁর প্রাথমিকে শিক্ষাকালীন সময়ে লেখা শুরু করেন এবং তাঁর বেশ কিছু লেখা স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকায় স্থান করে নেয়। অপেক্ষাকৃত স্বল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও স্বামী এবং পরবর্তীতে সন্তানদের আন্তরিক সমর্থনে তাঁর কাব্য সাধনা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে তিনি নানা সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যান। অসংখ্য সংকলিত ও বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেলেও "পূর্ণিমার হৃদয়ে অমাবস্যা" একটা ব্যাতিক্রমি সময় ও বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করবে বলে আমার বিশ্বাস। যেখানে মানব প্রেম, দেশপ্রেম, বিশ্ব পরিস্থিতি, মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় কৃষ্টি কালচার ও একান্ত নিজস্বী চিন্তা—চেতনা বোধ সম্বলিত কবিতাগুলো জায়গা করে নিয়েছে। নাম ভূমিকায় লেখা কবিতা "পূর্ণিমার হৃদয়ে অমাবস্যা" কবিতাটিতে কবি বলেছেন— দানবেরা খেয়ে ফেলেছে আবাদ ধূ ধূ বিরান মাঠে কোনো সুখ স্মৃতি নেই যেন, শুধু বিশাল এক নৈঃশব্দের কাল। নাম ভূমিকায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে কাব্যগ্রন্থটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে উন্নয়ন ও সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করছে কিছু স্বার্থান্বেষি ক্ষমতাবান চরিত্র,বিষয়টি এই চরণ দ্বয়ে চমৎকার ভাবে প্রতিভাত। কবি চিরাচরিত ভাবধারাকে এড়িয়ে শব্দের উচ্চমার্গীয় ব্যবহারে মূল বোধকে চমৎকারভাবে আড়াল করে পাঠককে ভাবনার জগতে ঠেলতে সমর্থ হয়েছেন। যা গদ্য কবিতার অন্যতম উপজীব্য। কবি বলছেন — গণতন্ত্র ভাসছে এখন গোরস্থানের পিঠে সওয়ার হয়ে, মৌলিক অধিকার জনতার কবেই বা ছিলো? (কবিতা—ভেসে যাচ্ছে মানচিত্র), বন্যায় অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকারে সংক্ষুব্ধ কবি ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিত করে জনগণের অধিকারকে সমুন্নত করবার মানসে অনন্য প্রতিবাদী উপস্থাপনা কবিতাটি জুড়ে । যা মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের হৃদয়কে নাড়া না দিয়ে পারে না। কবি বন্যায় জলমগ্ন অসংখ্য মানুষকে মানচিত্রের সাথে তুলনা করে, তাদের বাঁচানোর চরম আর্তি প্রকাশ করেছেন। এমন মানবিক আহ্বান সম্বলিত বেশ কিছু কবিতা স্থান করে নিয়েছে কাব্যগ্রন্থটিতে। আছে দেশের উন্নয়ন ও ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারকে আশ্রয় করে লেখা কবিতা। কবি তাঁর আরো একটি কবিতায় বলছেন— তমসাময় সকালে সমস্যাহীন রোদ, যদি হাত ধরো এনে দিবে নারী আশংকাহীন বোধ। (কবিতা— যদি হাত ধরো) এখানে কবি পুরুষের পাশাপাশি নারীও যে ব্যক্তি, পরিবার ও দেশের জন্য পরিপূরক, তা বলতে চেয়েছেন । তাই কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রেখে চলবার আহ্বান জানিয়েছেন কবি। তাহলেই তমসাময় সকালেও ঝলমলে রোদের দেখা মিলবে। এমন চমৎকার বক্তব্য সম্বলিত দারুণ সব কবিতা পড়ে পাঠক মন আন্দোলিত হবে নিশ্চিত। এছাড়াও গ্রন্থটিতে— সমসাময়িক গল্প, ইডেন কড়চা, জয় বাংলা জয় বাংলাদেশ, অথর্ব প্রশ্ন, জীবনবোধ, উচ্ছেদ সহ বেশ কিছু কবিতা পাঠে পাঠক ভিন্ন স্বাদ আস্বাদন করবে বলে আমার বিশ্বাস। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করছে চারু সাহিত্যাঙ্গন, হাসনাত সাইফুলের করা প্রচ্ছদ নজরকাড়া। বইটির সৌন্দর্যও পাঠককে টানবে বলে মনে করি। যথেষ্ট সতর্কতা সত্বেও মুদ্রণ বিভ্রাট অসম্ভব নয়। তবে ক্রুটিমুক্ত পরবর্তী সংস্করণের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। সবশেষে বইটির সর্ব্বোচ্চ পাঠক প্রিয়তা প্রত্যাশা করছি।