মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় তাজুল মোহাম্মদের কোনো তুলনা নেই। তিনি ইতিহাসের খোঁজে চারণের মতো ঘুরে ফিরছেন বাংলার প্রত্যন্ত জনপদ, তুলে আনছেন মানুষের দুর্ভাগ্য ও অদম্য প্রতিরোধের পরিচয়। অগণিত মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা, সরজমিন অবলোকন দ্বারা তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে প্রণীত হয় তাঁর প্রতিটি গ্রন্থ, যেখানে প্রান্তিক ইতিহাসের নানা পরিচয় আমরা পাই। অন্যদিকে তাজুল মোহাম্মদ প্রণীত ভাষ্যসমূহ একত্রে পাঠকালে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে ইতিহাসের বড় ছবি। দেশজুড়ে চল্লিশাধিক জনপদে পাকবাহিনী সংঘটিত নৃশংসতার পরিচয় রয়েছে এই গ্রন্থে, হৃদয়-আলোড়িত করা এসব বর্বরতার বয়ান পাঠ করা কঠিন, সেইসাথে এটাও স্মরণ করতে হয় যে-বর্বরতা কখনো দেখেনি কেউ সেটা ভুলে যাওয়াও বর্বরতারই নামান্তর। একাত্তরের নৃশংসতার কথা আমরা হয়তো জানি, তবে সেই বর্বরতার ভয়ঙ্করতা সম্পর্কে ধারণা আমাদের স্পষ্ট নয়। তদুপরি যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে, সমাজে যারা আজ সংখ্যায় গরিষ্ঠ তাদের তো জানার রয়েছে অনেক । আমরা যেন বিস্মৃত না হই গণহত্যার বাস্তবতা, স্মরণে রাখি নৃশংসতার কৃষ্ণ-গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের এবং ইতিহাস থেকে গ্রহণ করি শিক্ষা। সে-কাজই করে চলেছেন তাজুল মোহাম্মদ, বর্তমান গ্রন্থ তাঁর এমন ব্রতের আরেক প্রকাশ, নব-প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে পাঠ্য।
তাজুল মােহাম্মদ সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ১৯৭২ সালে। আর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার কাজে হাত দেন ১৯৭০ সালে। তখন থেকেই লেখালেখি করছেন এ বিষয় নিয়ে। ১৯৮৯ সালে। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “সিলেটে গণহত্যা'। এ গ্রন্থের সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি। সিলেটের যুদ্ধ কথা’-সহ আরও চার-পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৪ সাল অবধি। সিলেটের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক আলােচনার কারণেই হয়তাে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ব্রিটেনের টুয়েন্টি টুয়েন্টি টেলিভিশনের। যােগাযােগ করে সে টিভি কর্তৃপক্ষ। নিয়ােগ করে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গবেষণার কাজে। ৯ মাসের গবেষণার ফল হিসেবে নির্মিত হয় ‘দা ওয়ার ক্রাইম ফাইল’ নামক প্রামাণ্য চিত্র। যা সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বের দেশে-দেশে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশে, ব্রিটেনে, যুক্তরাষ্ট্রে। এর আগেই তাজুল মােহাম্মদের ওপর হুমকি আসে মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়েত শিবিরের পক্ষ থেকে। এক সময় দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। দেশের বাইরে থেকেও আন্দোলন করেছেন তিনি। বসতি গড়েছেন কানাডায়। বছরে কয়েক মাস দেশে অবস্থান করে চালান গবেষণাকর্ম। বাকি সময় কানাডায় বসে লেখালেখি করেন। গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে ষাটের অধিক। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণার জন্য লাভ করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পেয়েছেন ইংল্যান্ডের টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু সম্মাননা। গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন যুবকের ন্যায়। তাজুল মােহাম্মদের জন্মস্থান মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। পরে থিতু হয়েছিলেন সিলেট শহরে।