ভূমিকা শেক্সপীয়ারের পর ইংল্যান্ডের যে কবি রচনা বৈচিত্র্যে, ব্যাপ্তি ও গভীরতার দিক থেকে এক বিশ্বজনীন স্বীকৃতি ও সম্মানের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করেন এবং এক অক্ষয় গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হন, তিনি হলেন জন মিলটন। ইংল্যান্ডে যে যুগে মহাকবি শেক্সপীয়ার জীবিত অবস্থায় ক্রমাগত কাব্য ও নাটক রচনা করেছিলেন, জন মিলটন সেই যুগে জন্মগ্রহণ করেও আপন কাব্যপ্রতিভাকে প্রতিষ্ঠিত করে এক স্বতন্ত্র মহিমায় ও স্কীয় বৈশেষ্ট্যে উজ্জ্বল হতে পেরেছিলেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন জন মিলটন। পিতা সিনিয়র মিলটন প্রোটেস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য পৈত্রিক সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়ে আদি নিবাস অক্সফোর্ডশায়ার ছেড়ে লন্ডনে এসে সুদ-বন্ধকীর কারবার করতে থাকেন। অবসর সময়ে সঙ্গীত রচনা করে খ্যাতি ও পারদর্শিতা লাভ করেন তিনি। ফলে বাড়িতে কাব্য ও সঙ্গীতের যে একটি রসঘন পরিমন্ডল গড়ে ওঠে সেই পরিমন্ডলে শৈশব থেকে মানুষ হতে থাকেন জন মিলটন। পরবর্তীকালে এই সঙ্গীতের প্রভাব নানাভাবে প্রতিফলিত হয় তাঁর বিভিন্ন রচনায়। জন মিলটনদের বাড়ির সামনে সদিয়ে প্রতিদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ করতে যেতেন সেকালের বিখ্যাতক কবি ও নাট্যকার শেক্সপীয়ার, আর বালক মিলটন তখন দরজার আড়াল থেকে সসম্ভ্রমে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তাঁর দিকে। উচ্চস্তরের এক কবি হবার এক গোপন অভিলাষ অন্তরে বাল্যকাল হতেই সঞ্চারিত হয় তাঁর মনে। জন মিলটনের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় সেন্ট পলস্ স্কুলে। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য যান কেম্ব্রিজ ক্রাইস্টস কলেজে। সেখান থেকে যথাকসময়ে বি.এ. ও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। এই সময়ে তিনি ‘অন দি ক্রাইস্টস নিটিভিটি’ এবং ‘লা এ্যালেগ্রো’ ও ‘ইল পেনসারোসো’ কবিতা দুটি রচনা করে দেশের কাব্যরসিকদের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উচ্চশিক্ষা শেষ করে লন্ডন শহর ছেড়ে উইন্ডসরের নিকটবর্তী হর্টনের গ্রাম্য বাড়িতে গিয়ে নির্জন ও মনোরম পরিবেশের মধ্যে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, সঙ্গীত, গণিতবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক ও গভীরভাবে পড়াশুনো আর কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন জন মিলটন। সেকালে ইংল্যান্ডে জাতীয় ভাবধারা ও চিন্তার জগতে রেনেসাঁভিত্তিক যে মানবতাবোধের জোয়ার চলছিল, রোমান ক্যাথলিক ধর্ম তার যাজকসর্বস্ব রক্ষণশীলতার জন্য একান্ত পরিপন্থী ছিল সে মানবতাবোধের। যে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ছিল রেনেসাঁর মূল কথা, সে চিন্তার বিকাশের কোন অবকাশ ছিল না ক্যাথলিক ধর্মপদ্ধতির মধ্যে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রোটেস্ট্যান্ট হয়ে পড়েন রেনেঁসা ভাবধারার সার্থক ধারক ও বাহক জন মিলটন। ক্যাথলিকদের মতে মানবজীবনের ঈশ্বরনিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। যাজকদের মধ্যস্থতা ছাড়া মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে স্বাদীনভাবে কোন যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবে না। কিন্তু রেনেসাঁর প্রবক্তা ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মতে স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধিসমন্বিত মানুষের ঈশ্বরনিরপেক্ষ এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে এবং মানুষ তার জীবনের বিচিত্র ঐশ্বর্য, অন্তরবৃত্তি ও কর্মশক্তির বিকাশ সাধন করে কসে অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। প্লেটোর ভাববাদী দর্শন ও আত্মতত্ত্ব, বেকনের সংস্কারমুক্ত কজ্ঞান ও সত্যানুসন্ধান জন মিলটনের রেনেসাঁভিত্তিক মানবতাবাদী বাবধারাকে উদ্দীপিত করে তোলে বিশেষভাবে। এই ভাবধারাই মিলটনের রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনাকে প্রভাবিত করে এবং রাজতন্ত্রের বিরোধী করে তোলে। ভোগবিলাসসর্বস্ব অভিজাত সম্প্রদায় পরিবৃত স্বাধিকারপ্রমত্ত যে রাজতন্ত্রের মধ্যে নীতি ও মানবতাবোধের কোন প্রতিষ্ঠা ছিল না, সে রাজতন্ত্র যাজকতন্ত্রের মতই ঘৃণ্য ও বর্জনীয় হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। লাতিন ও ইংরেজি ভাষার কতকগুলি সনেট ও খন্ড কবিতা রচনার পর কাব্য-নাটিকা ‘কমাস’ ও শোকসূচক কবিতা ‘লাইসিডাস’ রচনা করেন জন মিলটন। কমাসে তিনি দেখিয়েছেন, যে অটল ঈশ্বরভক্তি ও ঈশ্বরবিশ্বাস মানুষের আত্মশক্তিকে শত গুণে বাড়িয়ে দেয় এবং আশ্চর্য পূর্ণতা দান করে তার আত্মাকে, সেই ভক্তি ও বিশ্বাসের বলে মানুষ যে কোন জাগতিক বিপদ হতে নিজের মুক্তি নিজেই রচনা করে নিতে পারে। এই ঈশ্বরবিশ্বাসভিত্তিক আত্মশক্তিই নারীদের মধ্যে সতীতত্ব ও তেজস্বিরূপে যে কোন পাশবিক আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে। ‘লাইসিডাস’ কবিতাটিতে সমুদ্রের নিমজ্জিত বন্ধুর প্রতি শোক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন যাজকদের বিপন্ন মানুষের প্রতি নির্মম ঔদাসিনাকে তুলে ধরেন। কাব্যরচনার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম, রাজনীতি, বিবাহ, দাম্পত্য সম্পর্ক প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে গদ্য রচনার কাজও চলতে থাকে। এই সব গদ্য রচনার মধ্যে ‘অফ এডুকেশান’ আর ‘এরোপ্যাগিটিকা’ প্রধান। জন মিলটন তাঁর অমর কাব্য ‘প্যারাডাইস লস্ট’ রচনা শুরু করেন ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে এবং তা শেষ করেন ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে। দ্বাদশ সর্গে বিভক্ত এই কাব্যটিকে আখ্যানকাব্য না বলে রূপকাব্য বলাই সংগত। এই কাব্যের প্রধান প্রধান চরিত্রগুলি হলো ঈশ্বর, ঈশ্বরপুত্র, দেবদূতগণ, শয়তানরাজ অধঃপতিত বিদ্রোহী দেবদূতগণ এবং মানবজাতির আদি পিতা, মাতা আদম ও ঈভ। স্বর্গ, স্বর্গোদ্যান, ইডেন ও মর্ত্যলোক জুড়ে এই কাব্যের পটভূমি বিস্তৃত এবং এর বিষয়বস্তু হলো শয়তানের প্রলোভনে ও প্ররোচনায় প্রথমে ইভের ও পরে আদমের নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ, ঈশ্বরের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনজনিত পাপ, তাদের পাপচেতনা ও অনুশোচনা, ঈশ্বরপুত্রকর্তৃক তাদের মৃত্যুদন্ড হতে অব্যাহতিদান ও অবশেষে মর্তলোকে তাদের পুনর্বাসন। আদি পিতা-মাতার এই পাপ তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে কি ভয়ঙ্কর পরিণামের সৃষ্টি করবে তার নমুনা আদমকে আগেই দেখিয়ে দেয় দেবদূত কয়েকটি দৃশ্যের মাধ্যমে। তবে সেই সঙ্গে আদম এই সান্ত¡না লাভ করে আশান্বিত হয়ে উঠেছে যে মানুষ তার অবিচল ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বরভিক্তির দ্বারা তার সব পাপ স্থলন ককরে এক বিশুদ্ধ জীবনে উত্তরণ ঘটাতে কপারবে তাদের। কিন্তু এই কাব্যের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, ঈশ্বর ও শয়তান, শুভ্র ও অশুভ্র, ভালোবাসা ও ঘৃণা, বিনয় ও ঔদ্ধত্য, স্বাধীনতা ও দাসত্ব, স্বাভাবিক সরলতা ও কৃত্রিম বিলাস-ব্যসন, স্বর্গলোক ও মহাকাশে নিয়ত ঘূর্ণ্যমান গ্রহ-নক্ষত্রের সুশৃঙ্খল অবস্থিতি এবং মানবজগতের নৈতিক বিশঙ্খলাÑ এই বিপরীত ভাবগুলি এক সমান্তরাল গতিশীলতায় স্বচ্ছন্দভাবে বিস্তারলাভ করেছে এই কাব্যে। আসলে মানবতাবাদী জন মিলটন এই কাব্যে একটি রূপকের মাধ্যমে ঈশ্বর, মানবাত্মা ও শয়তানের ত্রিকোণাত্মক সম্পর্কটিকে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে শয়তান অশুভ শক্তির প্রতীক আর নিষিদ্ধ ফলভক্ষণ মানবজাতির যাবতীয় পাপকর্মের প্রতীক। এই শয়তানরূপী অশুভ শক্তি মানবত্মাকে প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ করে তোলার চেষ্টা করবেই। কিন্তু মানুষ যদি ঈশ্বরপ্রদত্ত তার স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির দ্বারা সে প্রলোভনকে প্রতিহত করে তার আত্মার শুচিতাকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে তাকে স্বর্গসুখ হারাতেই হবে। একমাত্র ভক্তি, বিশ্বাস, নিরন্তর প্রার্থনা ও অনুশোচনার দ্বারাই সে পাপমুক্ত হয়ে আবার ফিরে পেতে পারবে তার হারানো স্বর্গসুখ। আতিকা ফাইরুজ
জন্ম মাতুলালয়ে, ৩০ অক্টোবর। বাবা : একেএম ফজলুল করিম, মা : মনোয়ারা বেগম। গ্রাম : লক্ষণপুর, পোস্ট : ভবানীজীবনপুর, উপজেলা : বেগমগঞ্জ, জেলা : নোয়াখালী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা। একযুগেরও বেশি সময় দৈনিক প্রথম আলোয় ‘প্রকৃতি’ কলামে লিখছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বাংলাদেশের নদী, বর্ণমালায় বাংলাদেশ, বিশ্বের সেরা দর্শনীয় স্থান, বাংলাদেশের মেলা, ঘুরে আসি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ফুল ও ফল, জীবনের জন্য বৃক্ষ, বিপন্ন প্রজাতির খেরোখাতা, প্রকৃতি ও প্রাণসম্পদ (সম্পাদনা), বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, ঋতুর রঙে ফুলের শোভা, আমাদের সবুজ বন্ধুরা, ভোরের ফুল সন্ধ্যার পাখিরা, আমাদের পার্ক ও উদ্যান, ছয় রঙের বাংলাদেশ, বাংলার শত ফুল, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার পুষ্প-বৃক্ষ ইত্যাদি। পরিবেশসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৩ সালে কাজী কাদের নওয়াজ স্বর্ণপদক, ১৪০৮ ও ১৪১০ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১১ সালে এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। নেশা ছবি তোলা ও ভ্রমণ।