গোর্কির মা উপন্যাসের নায়কদের আমরা ছেড়ে আসি তাদের ঘোর দুঃসময়ে। পাভেল ভøাসভ অপেক্ষা করছে তার হাজার ভার্স্ট যাত্রা, সাইবেরিয়ায় যাবজ্জীবন নির্বাসন। আদালতে পাভেল যে বক্তৃতা দিয়েছিল তার বয়ান-ছাপা বেআইনী প্রচারপত্রের স্যুটকেস সমেত নিলভনা ধরা পড়েছে সশস্ত্র পুলিসের হাতে, তারা তাকে লাঞ্ছিত করছে, মারছে, আর ভিড় করে আসা লোকেদের সে বলতে চাইছে জীবনের সত্য কী... জল্লাদদের মুখের ওপর সে চেঁচিয়ে উঠেছে : ‘রক্তের সমুদ্দুর বইয়ে দিলেও সত্যকে ডুবিয়ে দিতে পারবে না! ... নির্বোধের দল! শুধু মানুষের ঘৃণাই কুড়–চ্ছ!’ কিন্তু গোর্কির উপন্যাস যে বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে লেখা, সেই পিওত্র জালোমভ এবং তাঁর মা আন্না কিরিলোভনার জীবনে কী ঘটেছিল? পিওত্র জালোমভ আরো অনেক দিন বাঁচেন, মারা যান যথেষ্ট বার্ধক্যে ১৯৫৫ সালে তাঁর আটাত্তর বছর বয়সে। তাঁর মা আন্না কিরিলোভনা জালোমভাও বাঁচেন অনেক দিন, যাঁর সম্পর্কে গোর্কি লিখেছিলেন, ‘...নিলভনা হলো পিওত্র জালোমভের মায়ের প্রতিচিত্র, সরমভোয় ১৯০২ সালের ১লা মে’র মিছিলের জন্যে পিওত্র জালোমভের বিচার হয়। তাঁর মা সংগঠনে কাজ করতেন, ছদ্মবেশে সাহিত্য পৌঁছে দিতেন...’ আন্না কিরিলোভনার জন্ম হয় ১৮৪৯ সালে, মুচি পরিবারে। জীবন তাঁর সুখের ছিল না। অবস্থা খুবই কঠিন হয় বিশেষ করে স্বামীর মৃত্যুর পর, সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে মাটির নিচের কুঠরিতে ‘বিধবার বাড়িতে’ একটি মাত্র ঠা-া বিমর্ষ খুপরি। কেবল মায়ের দৃঢ়তা ও পরিশ্রমেই সংসারটি রক্ষা পায়। ক্রমে ক্রমে বড় হলো ছেলেরাÑ বড়টি গেল কাজে, ছোটটি লেখাপড়ায়। পিওত্র যোগ দেন বিপ্লবী চক্রে এবং ‘আমাদের জীবনে আসে একটা তাজা, চাঙ্গা হাওয়া’। পুরনো কথা মনে করে বলে পিওতরের ছোট বোন ভারভারা জালোমভা। শিগগিরই জালোমভদের গোটা পরিবারই বিপ্লবী অন্দোলনে যোগ দেয়। অক্টোবর বিপ্লবের পর আন্না কিরিলোভনা দিন কাটান কখনো লেনিনগ্রাদে ছোট মেয়ের সংসারে, কখনো সরমভোয় ছেলেদের কাছে ছোটখাটো চেহারার এক বৃদ্ধা তখন তিনি, আশ্চর্য জীবন্ত চোখে অমায়িক হাসি। শাদা চুল তাঁর সাধারণত ঢাকা থাকত সেকেলে ঢঙের কালো শালে। লেনিনগ্রাদের উরিৎস্কি নামে কারখানার মজুরানী, নিজ্নি নভ্গরদের ছাত্র, সরমভোর মজুরÑ যারা তাঁকে দেখেছে, কথা কয়েছে, যাদের কাছে তিনি তাঁর অতীতের কথা, বিপ্লবী কাজের কথা, ছেলের কথা বলেছেন সরল সাদামাটা ঢঙে, তাদের সকলের কাছেই তাঁর ওই চেহারাটাই মনে আছে। আন্না কিরিলোভনা মারা যান ১৯৩৮ সালে। কিন্তু ফেরা যাক পিওত্র জালোমভের জীবনীতে ... জার আদালতের রায়ে ১৯০৩ সালে পিওত্র জালোমভ পায়ে হেঁটে রওনা দেন সাইবেরিয়ার নির্বাসনে। এক বছর পরে তিনি পৌঁছান ইয়েনিসেই নদী, সেখানে ক্রাসনোয়ার্স্ক থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে ছোট একটি বসত মাকলাকভকায় ডেরা পাতেন ... ‘নির্বাসনে কাটায় দু’বছর, স্থানীয় চাষিদের মধ্যে প্রচার চালায়, ভলোস্তের পেশকার এবং তার দুই সহকারীকে দলে টানে। আলেক্সেই মাক্সিমভিচ গোর্কি প্রতি মাসে তাঁকে আট রুবল করে পাঠাতেন, এলাকার দারোগা সেটি মেরে দিত। উপোস দিতে হতো আমরায়, সে স্কার্ভি রোগে পড়ে...।’ পিওতরের জীবনের একটি শুভদিন শুরু হয় ১৯০৪ সালের রোদভরা মার্চের প্রত্যুষে। নিজের ক্ষুদে কুঠরিটায় বসে ফার কাঠের স্কি বানাচ্ছিলেন তিনি। ‘স্থির সমতালে তাল পড়ছে হৃৎপি-ে... হঠাৎ দরজা খুলে গেল। হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি আমার কাছে এসে হাজির হলেন জোসেফিনা এদুয়ার্দোভনা, গায়ে একটা পুরনো শাদাটে লোক-কোট, ঠা-ায় গোলাপি হয়ে উঠেছে মুখ।’ পুরনো কথাপ্রসঙ্গে বলেন পিওত্র জালোমভ। দুই পেশাদার আত্মগোপনকারী বিপ্লবীর প্রণয়কাহিনীটা রুক্ষকঠিন। মস্কোর তরুণী শিক্ষিকা জোসেফিনা গাশেরের (জাতিতে ফরাসিনী) সঙ্গে পিওতরের পরিচয় হয় ১৯০১ সালেই। দেখা হতো শ্রমিক সভায়, বৈঠকে, সাক্ষাৎ হতো নিজনি নভগোরদের রাস্তায়, কিন্তু মন দেওয়া-নেওয়ার কথাটা কেউই তুলতে পারেন নি। শুধু পিওত্র জালোমভ যখন গ্রেপ্তার হয়ে মস্কোর বুতিরস্কায়া জেলখানায় তাঁর ভাগ্যের প্রতীক্ষা করছিলেন কেবল তখনই আন্না কিরিলোভনার সঙ্গে জোসেফিনা গাশের তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন তাঁর ভাবি ‘বধূ’ হিসেবে ... গোর্কির সাহাষ্যে নির্বাসন থেকে জালোমভের পলায়নের ব্যবস্থা হয়। পিটার্সবুর্গের বলশেভিক গুপ্ত সংগঠনে কাজ করেন জালোমভ, ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পূর্বে মস্কোয় শ্রমিক যোদ্ধৃবাহিনী সংগঠনে অংশ নেন। পিওত্র জালোমভের সঙ্গে আলেক্সেই মাক্সিমভিচ গোর্কির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯০৫ সালের গ্রীষ্মে, পিটার্সবুর্গের উপকণ্ঠে কুয়োক্কালে গোর্কির পল্লিভবনে। ভবিষ্যৎ উপন্যাসের লেখক এবং যাঁকে নিয়ে আঁকা হবে ভবিষ্যৎ পাভেল ভøাসভ তাঁদের মধ্যে জানাশোনা ছিল, কিন্তু দেখা হয় নি কখনো। সরমভোর ১লা মে মিছিলের আগে থেকেই আলেক্সেই মাক্সিমভিচ গোর্কি দেখা করতে চেয়েছিলেন জালোমভের সঙ্গে, কিন্ত পিওত্রের ভয় ছিল এতে গোর্কির ক্ষতি হতে পারে, কেননা পুলিস দপ্তরে তখনই গোর্কির ‘সুনাম ছিল না’, জানা ছিল যে বিপ্লবী লেখককে হেনস্থা করার জন্য পুলিস যে কোনো সুযোগ খুঁজছে। ১ মে’র মিছিল এবং তার নেতাদের গ্রেপ্তারের পর গোর্কি জালোমভ ও তাঁর কমরেডদের পৃষ্ঠপোষকতা চালিয়ে যান। পিওতরের মা আন্না জালোমভা মারফত গোর্কি তাঁর নিজ শহরবাসী নিজ্নি-নভ্গরদীদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। সাইবেরিয়া ‘প্রাণধারণের টাকা পাঠাতে গোর্কির কোনো মাসেই ভুল হয় নি। জালোমভের সংসার পাতার খবর পেয়ে টাকাটা তিনি দ্বিগুণ করে দেন এবং শেষত তিনশ টাকা পাঠান ‘পালাবার জন্য’। তারপর ফেরারি এবার পিটার্সবুর্গে, তাঁর প্রথম দিককার একটা সাক্ষাৎই গোর্কির সঙ্গে। গন্তব্য স্টেশন আসবার আগেই (পাছে টিকটিকি লাগে পেছনে) পিওতর ট্রেন থেকে নেমে বনে ঢোকেন, পল্লিভবনের বেড়ার কাছে গিয়ে থামেন। দেখেন আঙিনায় লম্বা শুকনোটে চেহারার একটি লোক, ছবি থেকে এ চেহারা তাঁর আগেই চেনা। ‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ!’ ডাক দেন পিওতর, নিজের পরিচয় দেন। গোর্কি এগিয়ে যান অতিথি বরণে, মুখে তাঁর সামন্ত্রণ হাসি। কোলাকুলি হলো এক এলাকার বাসিন্দা দুই ভাই যে-ভাইয়ে। গৃহকর্তা উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন জালোমভকে। ‘তাহলে এই হলেন আপনি!’ তারপর আরামকেদারায় আয়েস করে বসে শুরু হলো তাঁদের লম্বা আলাপ। গোর্কি তাঁর সাহিত্যিকের দৃষ্টিকোণ থেকে জিজ্ঞাসা করেন পিওতরের তাঁর মা-বাপ, তাঁর বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ, সরমভোর মিছিলের কথা। শ্রমিক প্রচারক কাজের লোকের মতো জানিয়ে যান শুধু ঘটনাগুলো, মন-মেজাজের কথা বলেন কম, স্বপ্ন-কল্পনার কথা আদৌ না। বন্ধুর মতো বিদায় নেন তাঁরা, ঠিক করে নেওয়া হলো আবার কবে দেখা হবে। এই সময় গোর্কি তাঁর এক বন্ধুর কাছে পিওত্র সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘সরমভোর একটা লোক আসে আমার কাছেÑ কী আশ্চর্য মানুষ!’ একের পর এক দায়িত্বশীল পার্টি কর্তৃব্য পালন করে যান পিওত্র। ‘মস্কোয় যোদ্ধৃবাহিনীর সংগঠক নিযুক্ত হই। মস্কোয় সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু হবার অল্প আগে আমার বৌ জোসেফিনা এদুয়ার্দোভনা জালোমভার সঙ্গে বোমার খোল তৈরির কাজে নামিÑ ইতি সাইবেরিয়া থেকে আমার কাছে চলে এসেছিলেন দশ মাসের মেয়ে নিয়ে ... অভ্যুত্থানের সময় ব্যারিকেড লড়াইয়ে অংশ নিই। ১৯০৬ সালে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি গলা দিয়ে রক্ত ওঠায় এবং একেবারে অশক্ত হয়ে পড়ায় বৈধ জীবনে ফিরতে বাধ্য হই।’ তাই কুর্স্ক গুবোর্নিয়ার ছোট একটি শহর সুজার রাস্তায় একদিন সপরিবারে দেখা দিলেন নিজ্নি নভ্গরদের মিস্ত্রি পিওত্র জালোমভ। পিওত্র জালোমভের পক্ষে সুজা’র জীবন হয়ে দাঁড়ায় কার্যত দ্বিতীয় এক নির্বাসন, কোথাও যাওয়া বারণ, কোথাও কাজ করা বারণ। পায়ে পায়ে অনুসরণ করত পুলিস। অনশন, জেলখানা ও নির্বাসনে ভেঙে পড়া জালোমভের স্বাস্থ্য এই সময় খারাপ হয়ে পড়ে। সংসার চালাতেন বৌ জোসেফিনা এদুয়ার্দোভনা, সুজা’র বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার একটা কাজ পান তিনি। সে সময়কার কথায় জালোমভ বলেন, ‘১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পর্যন্ত বরাবর ছিলাম পুলিস গোয়েন্দার কঠোর নজরাধীনে, সম্ভব ছিল কেবল চাষিদের মধ্যে শুধু ব্যক্তিগতভাবে কাজ চালানো।’ এলো সতেরো সালের ফেব্রুয়ারি তারপর অক্টোবর। সরমভোর নিশানবরদার, অপরাহত বিপ্লবী ফের ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘটনাবর্তে। প্রথম জনসভাতেই পিটার্সবুর্গের ঘটনাবলির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন চাষি ও কারুজীবীদের কাছে। নিজের ভাই আলেক্সান্দরের কাছে চিঠিতে পিওত্র জালোমভ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের সময় তাঁর জীবনের যে বর্ণনা দেন তা খুবই জীবন্ত : ‘... ১৯১৭ সালে উয়েজ্দে সোভিয়েত রাজ সংগঠনে অংশ নিই... শিগরিই নির্বাচিত হই শ্রম কমিশার। ‘সুজা দখল করে রাখার সময় শ্বেতরা বারকয়েক আমায় ঝোলাবার আয়োজন করে, কিন্তু তিনবারই ফাঁসির দড়ি এড়িয়ে যাই। শেষ বার গ্রেপ্তার হই দেনিকিনীদের হাতে, কোর্ট-মার্শালে বিচার হয়। জেলের কর্তারা লাঞ্ছনা করত আমায়, প্রায় প্রতিদিনই ভয় দেখাত ফাঁসি দেবে, গুলি করে মারবে... লাল ফৌজ এসে না পড়লে এ সিদ্ধান্ত তারা কার্যকরীও করত।’ জালোমভের প্রাণ বাঁচায় লাল ফৌজ, কিন্তু শক্তি তখন আর তাঁর কিছু ছিল না। গুরুতর চিকিৎসা দরকার। জালোমভ যান মস্কোয়, দীর্ঘদিন কাটান হাসপাতালে, ক্রমে ক্রমে শক্তি ফেরে, যোগাযোগ হয় পুরনো বন্ধুদের (খ্যাতনামা বিপ্লবী লেনিনপন্থী গ্লেব ক্রজিজানভস্কির পরিবারের) সঙ্গে, নতুন মোড় নেয় গোর্কির নায়কের জীবন। জাত আন্দোলক হওয়ায় পিওত্র জালোমভ চাষিদের মধ্যে প্রচুর কাজ চালান। পত্রিকা পড়ে শোনাতেন, সহজ করে বোঝাতেন গ্রামাঞ্চলে সোভিয়েত রাজের নীতি কী, সরকার কী কী নতুন ডিক্রি ও নির্দেশ জারি করছে। কলখোজ আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন পিওত্র সুজা’র চাষিদের নিয়ে গড়েন ‘লাল অক্টোবর’ কলখোজ। কয়েক বছর তিনি এর সভাপতিত্ব করেন, পরে কাজ করেন ব্যবস্থাপক ম-লীর সভ্য হিসেবে।
(মার্চ ২৮, ১৮৬৮ – জুন ১৮, ১৯৩৬) বিখ্যাত রুশ সাহিত্যক। তিনি নিজেই তার সাহিত্যক ছদ্মনাম হেসেবে বেছে নেন 'গোর্কি' অর্থাৎ 'তেতো' নামকে। তার অনেক বিখ্যাত রচনার মধ্যে মা একটি কালজয়ী উপন্যাস। প্রথম জীবন মাক্সিম গোর্কি নিঞ্জি নভগরদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন হন। ১৮৮০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি তার দাদীমাকে খুঁজতে গৃহ ত্যাগ করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং দীর্ঘ ৫ বছর ধরে পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমন করেন। তিনি ১৮ জুন ১৯৩৬ (৬৮ বছর) সালে মৃত্যু বরণ করেন।